আলীকদমে মুক্তিযোদ্ধা কান্ত ত্রিপুরার অসহায় দিনযাপন

Kanto Tripura_PP

মমতাজ উদ্দিন আহমদ, আলীকদম:
হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ফেরত পেলেও সম্মানি ভাতা বা কোন অনুদান পাচ্ছেন না আলীকদমের মুক্তিযোদ্ধা কান্ত ত্রিপুরা। স্বাধীনতার ৪৩ বছরেও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি সরকারি কোন ভাতা বা অর্থ সহায়তা। এক সময় মাসিক ৫শ‘ টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানি ভাতা পেতেন। এখন সে ভাতাও বন্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর কাছে রয়েছে সনদপত্রও। এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে বটে। হতভাগ্য মুক্তিযোদ্ধার নাম কান্ত ত্রিপুরা। তিনি এখন বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় বাস করলেও এক সময় ছিলেন রোয়াংছড়ি উপজেলায়। তার বাবা ছিলেন ওই উপজেলার মৌজা হেডম্যান। তার পিতার নামীয় জায়গা জমি এখন বেদখলে।

জানা গেছে, বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার গ্রামে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উপজাতি মুক্তিযোদ্ধা কান্ত ত্রিপুরা। দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ ৪৩ বছরেও তিনি নিজের নামে একখণ্ড জমি কিনতে পারেননি। একসময় তাঁর পিতা রোয়াংছড়ি উপজেলার হেডম্যান ছিলেন, এখন পিতার নামীয় জমিগুলোও বেহাত হয়ে গেছে। আলীকদমে মাতামুহুরী রেঞ্জের একখণ্ড জমিতে ভাঙা মাচাং ঘরে বসবাস করছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি স্বরূপ কান্ত ত্রিপুরার রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় প্রদত্ত সনদ। সনদ নং-ম-৬০৭০০। স্মারক নং- চট্টগ্রাম-১৮-১২৪৭, তারিখ ১৬/০৯/২০০৪ ইং। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিবের যুক্ত স্বাক্ষরিত এ সনদে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করা হয়েছে। ওই সনদে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার প্রদত্ত যাবতীয় প্রাপ্য সুবিধাদি ভোগ করার কথাও বলা হয়েছে।

কান্ত ত্রিপুরা বলেন, তার মুক্তিযোদ্ধার সনদটি ৮/৯ বছর আগে পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে করা একটি আবেদনের সাথে গেঁথে দিয়েছিলেন। সেটি তখন থেকেই হারিয়ে যায়। গত বছরের মার্চ মাসে পত্র-পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর জেলা পরিষদ থেকে তার সনদটি ফেরত পাঠানো হয়।

তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়েও জীবন সংগ্রামে তিনি হেরে গেছেন। কান্ত ত্রিপুরার বয়স এখন ৭৫। এ বয়সেও সংসারের ঘানি টানতে প্রতিদিনই তাঁকে দিনমজুরী কিংবা বনজঙ্গল থেকে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে অর্থের যোগান দিতে হয়। অবশ্য তিনি তিনকন্যাকে আগেই বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রীসহ তিনি বাস করেন বন বিভাগের জমিতে ভিলেজার হিসেবে।

কান্ত ত্রিপুরা মুক্তিযুদ্ধের স্মতিচারণ করে বলেন, মেজর হেমন বাবুর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ৭৫ জনের মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে ভারতের ফারুয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের কাছ থেকে পান থ্রি নট থ্রি রাইফেল। একটানা ২৭ দিন প্রশিক্ষণ শেষে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আসেন। ৮বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর টিএম আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি।

কান্ত ত্রিপুরা বলেন, রোয়াংছড়ি উপজেলার কানাইজো পাড়ায় পাক বাহিনী ও তাদের মিত্রশক্তি ভারতের মিজোরামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের বিরুদ্ধে সুবেদার মেজর টিএম আলীর নেতৃত্বে একটি সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ১০ থেকে ১২ ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৩০ জন শহীদ হন এবং শত্রু পক্ষের একজন মারা যান। এ যুদ্ধে তিনিসহ আটজন উপজাতি মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে সুচিমং মার্মা ও লাইংগ্যা বম নামে দু’জনের নাম স্মৃতিতে রয়েছে তার। মুক্তিযুদ্ধ শেষে অন্যদের সাথে তিনি চট্টগ্রাম জেড ফোর্সের সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমানের হাতে অস্ত্র জমা দেন।

বয়সের ভারে চোখের দৃষ্টি শক্তিও হারাতে বসেছেন। নেই কাজ করার সামর্থ্য। মুক্তিযোদ্ধা হলেও জীবিকার তাগিদে এখন তিনি দিনমজুর। এক সময় মাসিক ৫শ‘ টাকা করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানি ভাতা পেতেন। এখন সে ভাতাও বন্ধ। তিনি হারিয়ে যাওয়া সনদটি জেলা পরিষদ থেকে ফেরত পেলেও জোটেনি কোন অনুদান। কান্ত ত্রিপুরা আক্ষেপ করে বলেন, যখন শান্তি আসেনি শেষ বয়সেও, মরণেই শান্তি খুঁজে পাবো।’

আলীকদম উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মহসিন সর্দার ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার মো. সেলিম চৌধুরী বলেন, কান্ত ত্রিপুরা একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, সরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় সুবিধাদি তাঁর প্রাপ্য। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন