উখিয়ায় নতুন রোহিঙ্গা শিবির নির্মাণ নিয়ে তোলপাড়

fec-image

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কঠোর নির্দ্দেশনা থাকা সত্বেও উখিয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরের পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে বসতি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। নতুন বসতি নির্মাণের নেপথ্যে মিয়ানমারের আরাকানে থাকা অবশিষ্ট সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গাকেও এদেশে নিয়ে আসার নতুন কৌশল কিনা তা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে দেথা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ও শঙ্কা। আর যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের স্বদেশ ফেরানোর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চীন সফরে রয়েছেন এমন সময়টিতে নতুন বসতি নির্মাণের ঘটনায় এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।

তদুপরি রোহিঙ্গাদের জন্য নতুন বসতি নির্মাণ করার স্থানটিও হচ্ছে একটি স্পর্শকাতর এলাকা। যে এলাকার পাহাড়ি গুহায় ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আবিষ্কার করা হয়েছিল দু’টি হরকত জঙ্গি ঘাঁটি। এই জঙ্গি ঘাঁটি থেকে বহু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সহ গ্রেফতার করা হয়েছিল ৪১ জন নিষিদ্ধ হরকত জঙ্গিকে। পরবর্তীতে আদালতে এসব জঙ্গিকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সেই সময় থেকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের লুন্ডাখালী পাহাড়ি এলাকাটির নাম হয় ‘হরকত পাহাড়।

এই পাহাড়টিতে গত কদিনের মধ্যে একদম নিরবে কয়েকশ ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। একই এলাকায় রোহিঙ্গাদের জন্য ঘর নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে। এসব ঘর নির্মাণের কাজ শুরুর পর থেকেই এলাকার লোকজন বাঁধা দিয়ে আসছিল।

এ নিয়ে উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন-‘ রোহিঙ্গা শিবিরের দেখভাল করার কাজে নিয়োজিত ক্যাম্প ইনচার্জ মোহাম্মদ রাশেদ এলাকাবাসীর কোন কথা অমান্য করেই এসব ঘর নির্মাণ কাজ তদারকি করে চলেছেন। সরকারি এই কর্মকর্তা (ক্যাম্প ইনচার্জ) দেশের স্বার্থ বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্বার্থকেই বড় করে দেখে যেন এসব কাজ করছেন।

ইউপি চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে আরও অভিযোগ তুলে বলেন, নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন নামের একটি এনজিও বিদেশি অর্থায়নে এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যান এলাকাবাসীর আশঙ্কার কথা তুলে ধরে বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই এক সুদুরপ্রসারি পরিকল্পনা নিয়ে রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পরবর্তী সময়ে মিয়ানমারের নির্যাতনের অজুহাত তুলে এপাড়ে নিয়ে এসেছে। এখনো পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা মাফিক আরাকানের বাদবাকি রোহিঙ্গাদেরও এপাড়ে নিয়ে আসার কাজ থেমে নেই-এমন দাবি ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরীর।

এদিকে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী গোপনে নতুন করে রোহিঙ্গা শিবির তৈরির উদ্বেগজনক তথ্য জানান।

উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, এধরণের উদ্যোগ এলাকাবাসীর কাছে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। যে সময়ে গোটা দেশবাসী রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরাতে তৎপর। এমন সময়ে রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গোপনে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে শিবির নির্মাণের ঘটনাটি মোটেই কাম্য নয়।

এ প্রসঙ্গে সীমান্তবর্তী এই উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আরও বলেন, এতে করেই প্রমাণিত হয় বাস্তবে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের এপাড়ে নিয়ে আসার বিষয়টি ছিল আন্তর্জাতিক গোষ্ঠির দীর্ঘদিনেরই পরিকল্পনা।

তিনি আরও বলেন, বর্ষার সময় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত রোহিঙ্গাদের অজুহাত দিয়েই নতুন করে দুটি স্থানে নতুন শিবির করা হচ্ছে।

এমন তথ্য শুনে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন-‘আমি এমন সময়ে এরকম খবরটি শুনে অবাক হলাম। কেননা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমার (জেলা প্রশাসক) কাছে কড়া নির্দেশনা রয়েছে যে, নতুন করে রোহিঙ্গাদের জন্য এক ইঞ্চি জমির জায়গাও দেয়া হবেনা। আমি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দ্দেশনা মোতাবেক কাজ করব। সেখানে নতুন করে রোহিঙ্গা বসতি করা হলে সেসব গুঁড়িয়ে দেয়ার নির্দ্দেশনা দেব।

এসময় সভায় উপস্থিত উখিয়া উপজেলা সহকারী ভুমি কর্মকর্তা (এসি ল্যান্ড) ফখরুল ইসলাম জেলা প্রশাসককে জানান, স্থানীয় প্রশাসনের তরফে তারা এসব নতুন বসতি স্থাপনের ব্যাপারে অনেক বাঁধা দিয়েছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত প্রশাসন তাদের বাঁধা অমান্য করে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠির কথা মতই নতুন বসতি স্থাপনের কাজ অব্যাহত রেখেছেন।

নতুন করে রোহিঙ্গা শিবির নির্মাণের এমন বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের অগোচরে এধরনের শিবির নির্মাণের কাজ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা সন্দেহ। ওদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের নামে মিয়ানমারের আরাকানকে বাংলাদেশের সাথে একাকার করার জন্য একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের নতুন করে প্রস্তাবনা উত্থাপনের পর পরই নতুন রোহিঙ্গা শিবির করার বিষয়টি নিয়ে এলাকার লোকজন সহজ ভাবে গ্রহণ করছেন না। এমনকি রোহিঙ্গা শিবির নিয়ে জেলা প্রশাসন ও রোহিঙ্গা তদারকির কাজে নিয়োজিত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে এক প্রকারের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয়টিও এলাকাবাসীর কাছে উঠে এসেছে।

তবে বিষয়টি নিয়ে রোহিঙ্গা শিবির তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত সরকারের অতিরিক্ত সচিব ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন-‘আমরা ইউএনএইচসিআর এর তহবিল নিয়ে এক স্থানে এ ধরণের সাড়ে তিনশ ঘর নির্মাণ করছি। অপরদিকে অন্যস্থানে বন বিভাগের সামাজিক আগর বাগানের ১০০ একর পাহাড়ি ভুমিতে আরও ৫০০ এর মত ঘর করছি। যা মোট জমির সাড়ে ৬ হাজার একরের ভিতর। আমরা কোনভাবেই সাড়ে ৬০০ হাজার একরের বেশি ব্যবহার করছি না।

তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে কারো ভুলবুঝাবুঝির অবকাশ নেই। তিনি আরও বলেন, এসব কাজ নতুন করে করা হচ্ছে না। এগুলো আগের কাজ মাঝখানে বন্ধ ছিল। তাই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় থাকা রোহিঙ্গাদের রাখার জন্যই এসব নির্মাণ করার কথা জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: উখিয়ায়, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন