উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প নোয়াখালীতে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ

10404394_663828223736618_6431447018282396953_n

কক্সবাজার প্রতিনিধি:
পর্যটন নগরী কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তাদের নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ওই এলাকার ৫০০ একর খাসজমি চিহ্নিত করে ক্যাম্প স্থাপনের একটি প্রকল্প নেওয়া হবে। প্রকল্পের আওতায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। খবর সমকালের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীতে সরানোর বিষয়ে সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প স্থাপনে জায়গা নির্বাচনে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে নির্দেশ দেন।

পরে প্রধানমন্ত্রীর এ সিদ্ধান্তের কথা চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার জানান, ৩৪ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীতে স্থানান্তরে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য ৫০০ একর খাসজমি প্রয়োজন। খাসজমি নির্বাচনের কাজ শুরু হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নোয়াখালীতে স্থানান্তরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা তিনি পেয়েছেন। এখন প্রাথমিকভাবে তাদের ক্যাম্প স্থাপনের জায়গা নির্বাচনে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক জায়গা নির্বাচন করলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাদের জন্য আলাদা কোনো প্রকল্প নেওয়া হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের জন্য একটি বড় প্রকল্প নেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে সরকারের। এ প্রকল্পটি নেবে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়।

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য জায়গা নির্বাচনে হাতিয়া ও সুবর্ণচরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। তাদের জন্য ৫০০ একর জায়গার কথা বলা হয়েছে। জায়গা নির্বাচনের কাজ চলছে। চরাঞ্চলের জায়গা দেখা হচ্ছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন জায়গা দেখতে হবে, যেখানে তাদের স্থানান্তর করলে সামাজিক অবক্ষয়ের সুযোগ থাকবে না। এটি বিবেচনা করেই জায়গা নির্বাচন করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে ভূমি সচিব শফিউল আলম বলেন, খাসজমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। সরকার তাদের নোয়াখালীতে স্থানান্তরে সিদ্ধান্ত নিলে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নোয়াখালীর হাতিয়া ও সুবর্ণচরে খাসজমি রয়েছে। এখানে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প করতে চাইলে সরকার করতে পারবে। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্প স্থাপনে খাসজমি বরাদ্দ করবে ভূমি মন্ত্রণালয়। তবে এখন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানেন না বলেও উল্লেখ করেন।

জানা গেছে, কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ায় দুটি শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩৪ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এদের পাশাপাশি টেকনাফের লেদা, নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং শরাণার্থী শিবিরসংলগ্ন বস্তিতে আরও লক্ষাধিক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

এ ছাড়া উখিয়া, টেকনাফসহ পুরো কক্সবাজার জেলা, পার্বত্য বান্দরবান জেলা সদর, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রাঙামটির কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, চট্টগ্রাম সিটি, চন্দনাইশ, পটিয়া, আনোয়ারা, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, সাতকানিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অবৈধ বসবাস। অবৈধ রোহিঙ্গাদের ৯০ শতাংশের বাস সরকারি খাস, চরাঞ্চল ও বনভূমিতে। ১০ শতাংশ বিভিন্নভাবে জায়গা-জমি ক্রয় করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে অবস্থান করছে। কক্সবাজারের দুটি শিবিরে অবস্থানকারী ৩৪ হাজার শরণার্থীর ভরণপোষণ সরকার ও ইউএনএইচসিআর (জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন) থেকে করা হলেও শিবিরসংলগ্ন বস্তিগুলোতে অবস্থান নেওয়া আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জীবন-জীবিকার নির্দিষ্ট কোনো উৎস নেই। ফলে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা চালাতে গিয়ে স্থানীয় লোকালয়ে মাটি কাটা, বাঁধ নির্মাণ, চাষাবাদ, ধান কাটা, গাছ কাটা, রিকশা চালানো, চা দোকান, বাড়িঘর ও সমুদ্রের ফিশিং বোটে, সংস্থায় শ্রম বিক্রি প্রভৃতি করে থাকে।

এদের বৃহৎ একটি অংশ মানব পাচার, হুন্ডি ব্যবসা, পতিতাবৃত্তি, মাদক পাচার, ইয়াবা ব্যবসা, জঙ্গিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এতে পর্যটন নগরীতে দিন দিন সামাজিক অবক্ষয় বাড়ছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিন আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধিকে বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরানো হলে জেলার ৮০ শতাংশ অপরাধ কমে যাবে। তিনি বলেন, কক্সবাজারের স্থায়ী বাসিন্দারা শান্তিপ্রিয়। অধিবাসীদের অধিকাংশ ধনী হওয়ায় তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কম। এখানে সংঘটিত বেশিরভাগ অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িত।

সরকার অবৈধ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ঢাকঢোল পিটিয়ে পদক্ষেপ নিলেও কাজ হচ্ছে না। সীমান্ত নিরাপত্তায় নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি সদস্যরা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও এসব এলাকার কিছু জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় স্থানীয় পাচারকারী চক্র বিজিবিকে ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গাদের পাচার করে আনছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। কয়েক মাস আগে উখিয়ার বালুখালীর ধামনখালী সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে স্থানীয় পাচারকারীদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা পাচারের সময় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী নাসাকার সঙ্গে পাচারকারীদের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে। গত এক বছরে উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিজিবি সদস্যরা প্রায় আট হাজার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাকে আটক করে সঙ্গে সঙ্গে সে দেশে ফেরত পাঠিয়েছে বলে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সঙ্গে ২৭৪ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তের গহিন জঙ্গল দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এ ছাড়া নাফ নদী ও সমুদ্রপথেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ আসছে। এ দেশে আগে থেকে থাকা রোহিঙ্গারাও এ ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করছে। পরে তারা শরণার্থী রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের সহায়তায় কক্সবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করছে। সীমান্ত পেরিয়ে যাতে কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গারা বাস না করতে পারে, এ কারণেই পর্যটন নগরী থেকে তাদের ক্যাম্প সরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন