parbattanews

উজাড় হয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি বনাঞ্চল সংরক্ষিত বনেও গড়ে উঠছে বসতি

অস্থির পাহাড় দিশেহারা মানুষ-৮

Ab_Sondorbone-purcha-pahar

আবু সালেহ আকন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে:

বাঘাইহাট থেকে সাজেক ৩৪ কিলোমিটার রাস্তা। পার্বত্য অঞ্চলে যেসব দুর্গম এলাকা রয়েছে তার মধ্যে এটি একটি। রাস্তার দুই ধারে পাহাড় আর পাহাড়। এর বেশির ভাগই সরকারের সংরক্ষিত বন। অথচ এই বনে কোনো গাছ নেই। দূর থেকে দেখলে পাহাড়গুলোকে ন্যাড়া মনে হয়। আবার এই সংরক্ষিত বনেরই কোনো কোনো এলাকায় বসতি গড়েছে পাহাড়িরা। গড়ে তুলেছে পাকা বাড়ি এবং দোকানপাটও।

স্থানীয় সূত্র বলেছে, সংরক্ষিত বনের গাছ হয়তো চুরি হয়ে গেছে; নয়তো পাহাড়ে জুম চাষের জন্য তা কেটে ফেলেছে পাহাড়িরা। আর এগুলো যাদের দেখার দায়িত্ব সেই বন বিভাগ একেবারেই চুপ। তবে বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘তারা অসহায়। এগুলো নিয়ন্ত্রণে তাদের কিছুই করার নেই।’ বন বিভাগের কর্তারা বলেন, সংরক্ষিত যেসব বন রয়েছে তার সবটুকুতে ঘুরে দেখারও সুযোগ নেই তাদের। ওখানে আরেক প্রশাসন কাজ করে।

বাঘাইহাট রেঞ্জের আওতায় রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে ৪৬ হাজার ৪৭৬ একর। এই এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে অনেক এলাকা এখন গাছপালা শূন্য। প্রধান সড়ক এবং বাজারঘাট এলাকা ছাড়া বেশির ভাগ এলাকা গাছপালাহীন। কোনো কোনো এলাকায় ছোট ছোট কিছু গাছ চোখে পড়েছে। আর বেশির ভাগ পাহাড়ই গাছশূন্য। স্থানীয় সূত্র বলেছে, এসব বনের গাছ অনেক আগেই চোরাকারবারীরা বিক্রি করে সাবাড় করে দিয়েছে। যে দু-চারটা গাছ আছে তা-ও রক্ষণাবেক্ষণ ও দেখভালের অভাবে এখন চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। যেকোনো সময় ওই গাছগুলোও হাওয়া হয়ে যাবে। অথচ এই এলাকায় আইন রয়েছে ব্যক্তিগত বনের গাছও কাটা যাবে না।

বাঘাইহাট বাজার থেকে সাজেক যাওয়ার পথে দেখা যায় আশপাশের অনেক পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। স্থানীয়রা বললেন, ওই পাহাড়গুলোতে আগুন লাগিয়ে গাছপালা পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে জুম চাষের জন্য। জুম চাষের সাথে পাহাড়িরাই জড়িত। ওসব পাহাড়ে গাছ লাগানো হলেও কোনো লাভ হয় না। কোনো এক সময় তা পুড়িয়ে সেখানে জুম চাষ করে পাহাড়িরা। এভাবেই ন্যাড়া হয়ে গেছে অসংখ্য পাহাড়। একই সাথে লাইন দিয়ে গড়ে উঠেছে বসতি। পাহাড়িরা এসব বসতি গড়ে তুলেছে।

কাছালং এলাকার বাসিন্দা সুকুমার চাকমা এ ব্যাপারে বলেন, তারা বছরের পর বছর এভাবেই জুম চাষ করে আসছেন। অপর দিকে, সংরক্ষিত এলাকায় বসতি স্থাপনের ব্যাপারে তিনি বলেন, মানুষ থাকবে কোথায়? বাধ্য হয়ে বনবিভাগের জায়গায় বসতি স্থাপন করছে। অনেক মানুষ এখন আর দুর্গম পাহাড়ে থাকতে পারে না। সেখানে অনেক ঝামেলা আছে। তাই বাধ্য হয়ে তারা রাস্তার আশপাশে সংরক্ষিত বনে বসবাস করে থাকেন।

এদিকে অনেক বনের গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এই চুরির কাজে জড়িত পাহাড়ের সশস্ত্র দলগুলো। তাদের রোধ করার যেন কেউ নেই। তারা যখন খুশি পাহাড়ের গাছ-বাঁশ কেটে নিয়ে চোরাকারবারীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। কাছালং রিজার্ভ ফরেস্টের অনেক বনে দেখা গেছে এভাবে গাছের মুড়োগুলো পড়ে আছে। বাঘাইহাট রেঞ্জের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে ১২-১৩ জন বনকর্মী রয়েছেন। তাদের হাতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই। অথচ যারা বন থেকে গাছ চুরি করে তাদের হাতে রয়েছে আধুনিক অস্ত্র।

ওই কর্মকর্তা বলেন, নিরস্ত্র বনকর্মীরা তাদের সামনে গিয়ে কিভাবে বাধা দেবে? বাধা দিতে গেলে উল্টো অপহরণসহ নানা নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

বাঘাইহাট রেঞ্জ কর্মকর্তা সৈয়দ গোলাম সাহিদ বলেন, ‘এখানে আমাদের কিছু সমস্যা আছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়েছি।’। তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের সরকার ছাড়াও আরেকটি সরকার কাজ করে।’ সৈয়দ গোলাম সাহিদ বলেন, ‘এখানে কিছুটা নিয়ম মেনে চলতে হয়। বনে যেতে অনেক সময় আমাদের অনুমতি নিতে হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গাছ চুরি থেকে নিবৃত করতে গিয়ে বনবিভাগের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালে শুভলং রেঞ্জের অফিসার রবিউল ইসলাম অপহৃত হয়েছিলেন। পরে ১৭-১৮ দিন নানা কাঠখড় পুড়িয়ে ওই কর্মকর্তাকে উদ্ধার করা হয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ডেরা থেকে। বাঘাইহাট রেঞ্জ কর্মকর্তা গোলাম সাহিদ বলেন, যতটুকু পারি বাধা দেয়ার চেষ্টা করি। অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে থাকতে হলে সমঝোতা করে থাকতে হয়। যেসব কর্মকর্তা এখানে চাকরি করেন সবাই সমঝোতা করেই করেন।’

Exit mobile version