উত্তর-পূর্ব ভারত: নিজ দেশেই বর্ণবৈষম্যের শিকার বাসিন্দারা, ‘প্রকৃত ভারতীয়’ কি-না তা নিয়েও প্রশ্নের মুখোমুখি হন

fec-image

মীরাবাঈ চানু টোকিও অলিম্পিকসের ভারত্তোলনে রুপা জয়ের পরে ভারতীয়দের উচ্ছাসের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমের একটি পোস্টে লেখা হয়েছে যে দেশের জন্য মেডেল জিতলে তবেই উত্তর-পূর্বের মানুষ ‘প্রকৃত ভারতীয়’ হয়ে ওঠেন, আর অন্য সময়ে তাদের ডাকা হয় নানা কুরুচিকর ভাষায়।

ওই পোস্টের পরে আলোচনা শুরু হয়েছে কেন নিজের দেশেই বর্ণবাদী বৈষম্যের শিকার হবেন উত্তর-পূর্বের মানুষ।

অভিনেতা মিলিন্দ সোমানের স্ত্রী অঙ্কিতার কোঁয়ার-যিনি নিজেও আসামের মানুষ-এই পোস্টটি করার পরে তা নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দা, যারা পড়াশোনা বা কাজের সূত্রে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় থাকেন, তারা বলছেন যে নিয়মিতই রাস্তাঘাটে তাদের বর্ণবাদের শিকার যেমন হতে হয়, তেমনই কাজের জায়গাতেও তাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরন করা হয় চেহারার জন্য।

মেঘালয়ের বাসিন্দা ফিলারিমা কলকাতায় থেকেছেন পড়াশোনার জন্য, যেমনটা থাকেন উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েক হাজার ছাত্র ছাত্রী। ওই অঞ্চলের আরও বহু মানুষ কলকাতায় কাজ করেন। গোটা দেশে সংখ্যাটা কয়েক লক্ষ।

ফিলারিমা এখন ফিরে গেছেন নিজের শহর মেঘালয়ের শিলঙে। সেখান থেকেই তিনি জানাচ্ছিলেন কলকাতায় থাকার সময়ে তাকে এবং তার মতো উত্তর-পূর্বের বাসিন্দাদের কীভাবে বর্ণবাদের শিকার হতে হয়েছে।

ফিলারিমার কথায়, “কখনও আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে আমি ব্রুস লি-র দূরসম্পর্কের আত্মীয় কী-না, অথবা চীনা ভাষা বলতে পারি কী-না, আমার ব্ল্যাক বেল্ট আছে কী-না! এগুলো বলা হত এমনভাবে যেন আমি চীনা নাগরিক।”

“একদিন তো রাস্তায় চীনা চীনা বলে ডাকা হয়েছে, আর বলা হয়েছে আমি যেন নিজের দেশে ফিরে যাই। অথচ যারা এগুলো বলতো, তাদের অনেকেই জানত যে আমি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দা। তবুও খুব হাল্কা চালে এ ধরণের কথা শুনতে হত – এমনকি শিক্ষিত মানুষদের মুখ থেকেও,” জানাচ্ছিলেন ফিলারিমা।

কখনও চীনা, কখনও নেপালী

উত্তর-পূর্বের বাসিন্দা, যারা অন্য প্রদেশে থাকেন, তাদের মধ্যে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, যাকে ওই অঞ্চলের বাইরে কোথাও কখনও অপমান হজম করতে হয়নি।

তাদেরকে কুরুচিকর নামে ডাকা, অশ্লীল কথা বলা, কখনও বা নেপালী, চীনা প্রভৃতি বলা – এসব সহ্য করতে হয়। আর সহ্যের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায় – যেমন কয়েক বছর আগে দিল্লিতে উত্তর-পূর্বের একাধিক বাসিন্দাকে মারধর করা হয়, মুখে থুতুও ছেটানো হয় – তখন জোরেশোরে প্রতিবাদ হয়।

কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই বাড়ি ফিরে চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছু করার থাকে না অনেকের।

যেমন বলছিলেন নাগাল্যান্ড থেকে কলকাতায় একটি নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করতে আসা এক নারী, যিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না। তার কথায়, “আমি যদি কাজের ক্ষেত্রে খুব ভালও করতাম, তাহলেও কোম্পানির কর্মকর্তারা কোনও ধরণের প্রশংসা করতেন না।

“অথচ সেই একই কাজটা যদি কোনও বাঙালি সহকর্মী করতো, তাহলে সে কিন্তু প্রশংসা পেত টিম লিডারের কাছ থেকে।”

তাদের অনেকে মনে করেন তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় কারণ তারা উত্তরপূর্ব ভারতের বাসিন্দা ।

‘বোধহয় দেখতে অন্যরকম, তাই বৈষম্য’

এই বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত সম্ভবত তিনি উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে গিয়েছিলেন বলেই। ভারতের বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে তাদের চেহারা ভিন্ন রকম – সেজন্যই এটা করা হত বলে তার ধারণা।

“এই অপমানগুলো আমি বাঙালি সহকর্মীদের কাছে বলতেও পারতাম না। উত্তর-পূর্বের অন্য বন্ধুদের সঙ্গেই এসব নিয়ে কথা হতো, আর বাড়ি ফিরে চোখের জল ফেলতাম। তবে এখন আমি নাগাল্যান্ডে ফিরে এসেছি। নিজের গন্ডির মধ্যে আমি অনেক ভাল আছি,” বলছিলেন নাম জানাতে না চাওয়া ওই নারী।

আসামের গুয়াহাটির সমাজকর্মী আঞ্জুমান আরা বেগম নিজে এ ধরণের আচরনের শিকার হননি, কারন তার চেহারায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছাপ নেই।

কিন্তু ভারতের বহু জায়গায় ভ্রমণ করার সময়ে তার যে ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারই কয়েকটা শোনাচ্ছিলেন তিনি।

মিজ আঞ্জুমানের মনে আছে রাজস্থানে গিয়েছিলেন তিনি সামাজিক কর্মকর্তাদের কোনও এক বৈঠকে। সেখানে তাকে নাগাল্যান্ড প্রসঙ্গে শুনতে হয়েছে যে ওই রাজ্যের বাসিন্দারা তো নগ্ন থাকেন – তারা নাকি পোশাক পরেন না।

নাগাল্যান্ডের লোকেরা কি নগ্ন থাকেন?

“নাগা শব্দটির যে অর্থ ওই সামাজিক কর্মকর্তারা জেনে বসে আছেন, সেটা হল নগ্ন। সেখান থেকেই তারা ধারণা করে নিয়েছেন যে নাগাল্যান্ডে কেউ পোশাক পরেন না।”

“তারা একবার জানতেও চাননি আমার কাছে যে স্থানীয় ভাষায় শব্দটার অর্থ আসলে কি!” যোগ করেন আঞ্জুমান আরা বেগম।

“এটা বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি যে উত্তর-পূর্ব সম্বন্ধে অন্য রাজ্যের মানুষরা নিজেরাই একটা ধারণা তৈরি করে নেন, যেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল।”

গুয়াহাটির এই সমাজকর্মী আরও বলেন, “আর একবার মেঘালয়ের এক সামাজিক কর্মকর্তা আর আমি কোনও একটা শহরের হোটেলে চেক-ইন করছিলাম একসঙ্গে। আমার কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চাইল রিসেপশনিস্ট, কিন্তু ওই মেয়েটির কাছে পাসপোর্ট চাইলো।”

“আমি প্রতিবাদ করাতে জবাব পেলাম যে বিদেশিদের কাছ থেকে পাসপোর্টই একমাত্র পরিচয়পত্র হিসাবে নেওয়া হয়। অর্থাৎ সে ভেবেই নিয়েছে যে মেঘালয়ের বাসিন্দা ওই বন্ধুটি চীনা!”

উত্তর-পূর্ব ভারতের বাসিন্দাদের সঙ্গে বর্ণবৈষম্য করা তো হয়ই, তবে বেশি অপমানজনক কথা শুনতে হয় সম্ভবত ওই অঞ্চলের নারীদের। তাদের উদ্দেশ্যে করা কটুক্তিগুলিতে অনেক সময়েই যৌনতা মেশানো থাকে।

পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্বের অধ্যাপিকা ঋতু সেন চৌধুরীর ব্যাখ্যা, উত্তর-পূর্বের নারীরা নানা জায়গায় চলে যান, তারা শিক্ষিত এবং স্বাধীনচেতা – যেটা ভারতের অন্য অঞ্চলের মানুষদের চোখে বেমানান।

সেজন্যই এই বর্ণবৈষম্য চলতে থাকে বলে তিনি মনে করেন।

এটা রেসিজিম, বর্ণবৈষম্য
“এটা ইনস্টিটিউশানাল রেসিজিম,” বলছিলেন তিনি। “ইটস নট ওনলি রেস, এখানে জেন্ডারও ভীষণভাবে রিলেটেড – যেখানে উত্তরপূর্ব থেকে যে ছাত্রীরা পড়তে আসছে, তাদের আলাদা করে রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশনের সম্মুখীন হতে হয়। এর কারণ বোধহয় উত্তর-পূর্বের মেয়েদের ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মেয়েদের থেকে মোবিলিটি বেশি, শিক্ষার হার বেশি। এবং এরা ইন্ডিপেন্ডেন্টও।”

ঋতু সেন চৌধুরী আরও বলেন, “এরা নানা জায়গায় গিয়ে পড়াশোনা করে, এদের পোশাক-আশাক ওয়েস্টার্নাইজড। এদের যে লাইফস্টাইল, সেটাও খুব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ধরণের। মেইনল্যান্ড ভারতে স্টিরিয়োটাইপটা ভাঙ্গা একটা সমস্যা।”

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর বাসিন্দারা এ ধরণের বর্ণবৈষম্যের শিকার হলে যে সবসময়ে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পান, তাও নয়।

যদিও দিল্লি পুলিশের একটি বিশেষ সেল আছে, যেখানে উত্তর-পূর্বের কোনও মানুষ বৈষম্যের শিকার হলে অভিযোগ করতে পারেন, আর অনেক ক্ষেত্রেই দ্রুত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু সেটা সব শহরে হয় না।

তাই উত্তর-পূর্বের ছাত্র ছাত্রীরা নিজেরাই নানা শহরে নিজেদের সংগঠন গড়ে নিয়েছেন – যেখানে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন, আবারও যৌথভাবে তার সমাধানও খোঁজার চেষ্টা করেন।

সূত্র: বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন