উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির তাণ্ডবে অতিষ্ঠ পার্বত্য চট্টগ্রামের জনজীবন

Raju Begum

মো: শামীম উদ্দিন:

পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া চাঁদাবাজির তান্ডব আর বাংলাদেশ সরকারের নীরবতা দেখে মনে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সাক্ষরিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তৎকালীন আওয়ামী সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতিদের অর্থাৎ সন্তুলারমা ও তার প্রতিপক্ষ বাহিনীকে চাঁদাবাজি করার বৈধ লাইসেন্স দিয়েছেন । চুক্তির পর উপজাতীয় সন্ত্রাসী তথাকথিত শান্তিবাহিনীর ক্যাডাররা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয় । এদের মধ্যে অন্যতম হল জে.এস.এস (সন্তুলারমার বাহিনী), জে.এস.এস সংস্কারপন্থী (সন্তুলারমার বাহিনী হতে আলাদা হয়ে যাওয়া), হিল উইমেন ফেডারেশন, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, ব্ল্যাক ডগ এবং শান্তি চুক্তির বিরোধী পার্টি ইউপিডিএফ (প্রসিত বিকাশ খীসার দল) বিভিন্নভাবে চাঁদা আদায় করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল বাঙ্গালীসহ শান্তিপ্রিয় সাধারণ পাহাড়ীদের ব্যবসা বাণিজ্য জীবনযাপন দুর্বিষহ করে তুলছে । পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ জীবন অতিবাহিত করছে নিরাপত্তাহীনতা ও উদ্বেগ উৎকন্ঠার মধ্য দিয়ে । কেউ যদি চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তবে তার নিম্নোক্ত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, যেমন:

১) ঐ ব্যক্তিকে অপহরণ করে মুক্তিপণ চাওয়া হয়।

২) গাছের, বাশেঁর , বেতের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় অথবা সেগুলো তাদের পছন্দমত স্থানে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়।

৩) মাছের গাড়ি আটকিয়ে রাখা হয় আর চাঁদা না দিলে মাছগুলোকে মাটিতে পুতে ফেলা হয়।

৪) ফলের বাগান, বিভিন্ন গাছ দিয়ে সৃষ্ট বনায়ন কেটে ধ্বংস করা হয়, যা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় মাঝে মধ্যে পরিলক্ষিত হয় ।

বর্তমানে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই পাহাড়ে উপজাতিয় সন্ত্রাসীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা । অনেকে মনে করে থাকে এইসব হতাহত ও সংঘর্ষের ঘ্টনা শান্তি চুক্তির পক্ষে ও বিপক্ষের কারণে তাদের মধ্যে হয়ে থাকে, কিন্তু বাস্তবে তা নয়। প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির আধিপত্য ও চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যে এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে । যারা শান্তিচুক্তির পক্ষে, তারা চাচ্ছে সরকারের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতা আদায় আর যারা বিপক্ষে, তারা চাচ্ছে চুক্তি নয় যুদ্ধের মাধ্যমে সরাসরি স্বাধীনতা। বোঝা যাচ্ছে উপজাতিয়রা “তালে মাতাল হলেও জাতে ঠিক” কেননা তাদের দুই দলেরই লক্ষ্য হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ।

বাংলাদেশের সকল সচেতন ও দেশপ্রেমিক জনগণের অবগতির জন্য উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদা আদায়ের কিছু বিবরণ নিম্নে তুলে ধরা হল:

১)    হাট বাজার ও অন্যান্য চাঁদার হার ধার্যের হিসাব:
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট বড় সকল হাট বাজার থেকে ব্যপক হারে চাঁদা কালেকশন করছে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা । উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির কাছে, বিভিন্ন বাজারের ইজারাদার সহ ক্ষুদ্র মাঝারি সকল ধরনের ব্যবসায়ীরা জিম্মী হয়ে আছে । দোকান পিছু  মূলধনের ভিত্তিতে চাঁদা ধার্য করে বাৎসরিক ২০০/-, ৩০০/-, ১০০০/-, হতে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে নেওয়া হয় । গরু, ছাগল, মহিষ, মুরগী, শাকসবজি, আলু, কচু, পিঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, ধান, চাউল, ও অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্য কেনা বেচা করলে চাঁদা দিতে হয় ।

২)    চাষাবাদের উপর চাঁদা আদায়:
জমিনে ফসল বুনলে: তরমুজ, শসা, লাউ, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, ঢ়েঁড়স প্রভৃতির উপর চাঁদা দিতে হয় । চাঁদার হার বিক্রয়লব্ধ টাকার ৫% । এক থানি জমির ধান কাটতে গেলে সেখানে থানে পিছু ১ মন ধান অথবা সমপরিমান টাকা চাঁদা দিতে হয় । তামাক চাষের জন্য প্রতি একর জমি পিছু প্রতি মৌসুমে ৩০০০ /- দিতে হয় । উল্লেখ, সাধারণ উপজাতীয় যারা পহাড়ে জুম চাষ করে তাদের কাছ থেকেও বিভিন্ন হারে চাঁদা আদায় করা হয় ।

৩)    চাকুরীজীবীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়:
প্রত্যন্ত এলাকায় বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী চাকুরীজীবী, স্কুল কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে বেতরে ১০ শতাংশ চাঁদা আদায় করে নেয় । উপজেলা ভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন ও হিসাব সেকশন যেখানে বিল পেমেন্ট হয় সেসব সেকশনে বাৎসরিক ৫০, ৬০, ৭০ হাজার চাঁদা ধার্য করা হয় । এছাড়া ও বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সেসব প্রতিষ্ঠানের চাকুরীজীবীদেরকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উৎসবের জন্য চাঁদা দিতে হয়।
৪)    বাস, ট্রাক, সিএনজি, জীপ, গাড়ীর উপর চাঁদা ধার্যের হিসাব:
গাড়ি                                                                                  চাঁদার পরিমাণ
বাস ( যে কোন ) বাৎসরিক                                                          ৫০০০ টাকা
ট্রাক ( গাছ ভর্তী ) বহির্গমন ট্রিপ মাথা পিছু                                        ২০০০ টাকা
সিএনজি ( তিন চাকার )বাৎসরিক                                                  ৭০০ টাকা
জীপ গাড়ি বাৎসরিক                                                                  ৩০০০ টাকা
মোটস সাইকেল ( বাৎসরিক )                                                        ২০০০ টাকা

সড়ক পথে যেসব জায়গা হতে চাঁদা আদায় করা হয় সেগুলো মধ্যে অন্যতম হল: খাগড়াছড়িতে তবলছড়ি ও পানছড়ি রাস্তার মরাটিলা, গোমতি মাটিরাংগা রাস্তার তাইফাছড়া, দীঘিনালা বাঘাইহাট সাজেক সড়কের বিভিন্ন স্থান, মহালছড়ি রাংগামাটি সড়কের কয়েকটি অঞ্চল, রাংগামাটিতে মারিশ্যা দূরছড়ি –  মাহিল্যা – লংগদু – বরকল নৌপথ ও আরো বিভিন্ন স্থান হতে চাঁদা আদায় করা হয় ।

৫)    বিভিন্ন জলযানের উপর চাঁদা ধার্যের হিসাব:
নদী নালা ও জলপথে চলা চলের লঞ্চ, স্টিমার, ইঞ্জিন বোটগুলো থেকে উপজাতীয় সন্ত্রাসী তথা চাঁদাবাজরা চাঁদা আদায় করে । প্রতি ঘোড়ায় বা অশ্ব ক্ষমতায় ১৫০ টাকা চাঁদা ধার্য করা হয় । লঞ্চের ইঞ্জিন গুলি ৫৫ ঘোড়ার জোর বাৎসরিক প্রতি লঞ্চকে দিতে হয় ৮,২৫০ টাকা । ১০, ১৫, ২২, ২৫ ঘোড়ার জোর ইঞ্চিন বিশিষ্ট বোট গুলিকে বাৎসরিক গড়ে ৩০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় ।

৬)    মৎস্য ব্যবসায়ীর উপর চাঁদা ধার্যের হিসাব:
মৎস্য ব্যবসায়ীরা ব্যবসার জন্য নিজ নাম রেজিস্ট্রেশন করতে এককালীন ১৫০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় । বের জালের খোপ, প্রতি বেরে মাছ ধরার জন্য বাৎসরিক ৪৫০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় । জেলেরা মাছ ধরার নৌকা প্রতি বাৎসরিক ১০০০ টকা । মৎস্য অবতরন কেন্দ্র থেকে বর্হিগমনে মাছ ভর্তি প্রতি ট্রাকে ২০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় । মাছ ধরার বর্শিতে বাৎসরিক ১০০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় ।

৭)    বাঁশ ও বেত জাতীয় বনজ সম্পদের উপৃর চাঁদা ধার্য:
বাঁশ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা যায় বাঁশের উপর প্রতি হাজার পিছু ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয় ।  বাঁশগুলি নদীর উজান থেকে নামিয়ে আনার সময় চাঁদার টাকা ঘাটে দিয়ে আসতে হয় এবং কালেক্টরের সিøপ নিতে হয় । অন্যথা বাঁশের চালি পথে আটকিয়ে রাখা হয়। বাঁশ ব্যবসায়ীদের ব্যবসার জন্য আগে ব্যক্তিগত রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হয় ২৫০০০ টাকার বিনিময়ে । বেত জাতীয় সম্পদ বাহিরে নিতে গেলে প্রতি ট্রাকে চাঁদা দিতে হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ।

৮)    গাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়:
তুলনামুলকভাবে বিভিন্ন ধাপে গাছ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশী চাঁদা আদায় করা হয় । যেমন:
ক) কোন লোক জোত পারমিট নিয়ে গাছের ব্যবসা করতে হলে প্রথমে তাকে রেজিস্ট্রশন বাবদ ৫০০০ টাকা দিতে হয় ।
খ) ব্যবসায়ী ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য ২৫০০০ টাকা বাৎসরিক চাঁদা দিতে হয় ।
গ) ব্যবসায়ী এবং চাঁদা আদায়কারীদের মধ্যে মিডিয়া হিসেবে একজন লোক থাকবে ফলে তার জন্য চাঁদা দিতে হয় বাৎসরিক ১৫০০০ টাকা ।
ঘ) পারমিটের গাছ চেক করার জন্য ফরেস্টের কোন অফিসার পারমিট স্থলে যাওয়ার জন্য অনুমতি ফি বাবদ ৪০০০ টাকা দিতে হয় ।
ঙ) ফরেস্টের কোন অফিসার পারমিটের গাছ জোতে চেক করতে যেতে হলে চাঁদা কালেক্টরের ( চীফের ) লিখিত অনুমতি নিতে হয় । অনুমতিতে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় কয়টি পারমিট তদন্ত করা হবে । অনুমতির বাহিরে অতিরিক্ত পারমিট তদন্ত করার কোন এখতিয়ার ডিএফও বা তার অধীনস্ত কোন কর্মকর্তার থাকবেনা। পার্বত্য এলাকায সরকারের নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের উপর নেই বললেই চলে ।
চ) পারমিটের গাছ যখন বাগানে কাটতে যাবে তখন সেগুন গাছ প্রতি ফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, গামারী ও অন্যান্য গাছ প্রতি ফুটে ২০ থেকে ২৫ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয় ।
ছ) গাছগুলি যখন লোড হয়ে সদরে আসবে তখন প্রতি ট্রাকে ১০,০০০ টাকা করে বিশেয চাঁদা দিতে হয ।
রাংগামাটি জেলাতে চাঁদাবাজদের চীফ কালেক্টর থাকে রাংগাপানি মৌজার হেডম্যান পাড়ায়, খগড়াছড়িতে থাকে পানখাইয়্যা পাড়ায় ।

উল্লেখ্য চাঁদাবাজির কারণে গাছ, মাছ ও অন্যান্য ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৪ থেকে ৭ লাখ মানুষ বেকার হয়ে যাবে । ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা ব্যহত হবে । অর্থনৈতিক ভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ পঙ্গু হয়ে যাবে । এই চাঁদাবাজির সমস্যা সমাধানে সরকার অতিদ্রুত আন্তরিকতার সাথে নিম্নোক্ত পদেক্ষেপ নিতে পারে:
১)    বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনাবাহিনী ক্যাম্পসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর টহল ক্যাম্প, স্থায়ী, অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা যেতে পারে ।
২)    চিরুনি অভিযানের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সকল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে ।
৩)    দরকার হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের নিরাপত্তার জন্য র‌্যাবের মত দক্ষ, চৌকস  আলাদা একটি বিশেষ বাহিনী গঠন করা যেতে পারে নতুবা র‌্যাবের তিনটি সম্পূর্ন ইউনিট পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি জেলায়  স্থাপন করা যেতে পারে ।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন