‘উড়ে যায় বকপক্ষী, পড়ে থাকে ছায়া’

Humayun-11

ফাঁসি বন্ধের দাবিতে মিছিলও হলো কয়েক জায়গায়। ফাঁসি বন্ধ না হলে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে। যার ফাঁসি নিয়ে এত উত্তেজনা তিনি কিন্তু বাস্তবের কোনো ব্যক্তি নন, তিনি একটি নাটকে দেখানো একটি কাল্পনিক চরিত্র। তিনি সবার প্রিয় বাকের ভাই।

শুধুমাত্র নিজের কলমের জাদুতে যিনি লাখো মানুষের আনন্দ-বেদনার ভাগীদার হয়ে গেছেন তার নাম হুমায়ূন আহমদে। স্যার আথর্ার কোনান ডয়লে যখন বইয়ের পাতা তার কালজয়ী চরিত্র র্শালক হোমসের মৃত্যু ঘটান তখন পাঠকরা ব্যাপক আন্দোলন করেছিল। পাঠকদের দাবীর মুখে তিনি শেষ পযর্ন্ত শালর্ক হোমসকে ফিরিয়ে আনেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে। হুমায়ূন আহমেদের দুটি নাটকের বেলায় দর্শকদের তরফ থেকে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। যদিও কোনোবারই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েননি নাটক দুটির স্রষ্টা।

হুমায়ূন আহমদেরে লেখা প্রথম ধারাবাহকি নাটক ‘এইসব দিন রাত্রি’। বুলবুল আহমদে, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর, লুৎফুন্নাহার লতা, আবুল হায়াতের মতো শিল্পীদের নিয়ে তৈরি নাটকটির কাহিনি গড়ে উঠছেলি শহুরে মধ্যবত্তি একটি পরিবারকে ঘিরে। নাটকের শেষে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরিবারের ছোট্ট মেয়ে টুনির মৃত্যু আলোড়িত করেছিল সব শ্রেণির দর্শককে, এসেছিল প্রতিবাদ, প্রার্থনা, অনুরোধ।

নব্বইয়ের দশকে প্রচারিত ‘কোথাও কেউ নেই’- নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন বাকের ভাই নামে পাড়ার এক মাস্তান। মুনা নামের মধ্যবিত্ত পরিবারের এক র্কমজীবী নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় সে। বাকের ভাই চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর আর মুনা চরিত্রে সুর্বণা মুস্তফা ছিলেন অনবদ্য। নাটকের শেষে নির্দোষ বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসি বন্ধের দাবিতে দর্শকরা মিছিল করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু শালর্ক হোমসের মতো বাকের ভাই ফিরে আসেননি। কোনো নাটক, চলচ্চিত্র কিংবা সাহিত্যকর্ম নিয়ে জনজীবনে এমন উত্তেজনা বাংলাদেশে কখনও সৃষ্টি হয়নি। নাটকে বিভিন্ন চরিত্রে আরও অভিনয় করেছিলেন আবদুল কাদের, মাহফুজ আহমদে, আবুল খায়ের, হুমায়ুন ফরিদি, আফসানা মিমি, মোজাম্মেল হোসেন।

হুমায়ূন আহমেদ নাটকে মূলত মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন জীবনের কথা, অনুভুতির কথা তুলে ধরেছেন। তার নাটকের সংলাপ হিসেবে এসেছে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। গ্রামীণ চরিত্র তুলে ধরার সময় আঞ্চলিক ভাষার অকৃত্রিম ব্যবহার করেছেন। তবে তার চরিত্রগুলো পরিশীলিত বাংলায় কথা বলেছে।

হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ অবলম্বনে সত্তরের দশকেই নির্মিত হয় নাটক। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমদে, আল মনসুর, মতিয়া চৌধুরী। আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদ টেলিভিশনের জন্য নিয়মিত নাটক লিখতে শুরু করেন। টিভির জন্য লেখা তার প্রথম নাটক ‘প্রথম প্রহর’ ১৯৮৩ সালে প্রচারিত হয়। নাটকটির প্রযোজক ছিলেন নওয়াজীশ আলী খান।

‘এই সব দিন রাত্রি’র পর হুমায়ূন আহমদেরে লেখা দ্বিতীয় ধারাবাহিক ছিল ‘বহুব্রীহি’।  এ নাটকেই টিয়া পাখির মুখে ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি ভীষণ জনপ্রয়িতা পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক র্সাথক অভিব্যক্তিতে পরিণত হয়। এ নাটকে অভিনয় করেছিলেন আবুল হায়াত, আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, আলী জাকের, লুৎফুন্নাহার লতা, আফজাল শরীফ, আফজাল হোসনে, আলেয়া ফেরদৌসী, দীপা ইসলাম।

হুমায়ূন আহমেদের ‘অয়োময়’ ধারাবাহিকটিও জনপ্রিয়তা পায়। এ নাটকে আসাদুজ্জামান নূর, সারা জাকের, লাকী ইনাম, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, সুর্বণা মুস্তাফা, মোজাম্মলে হোসনে, দীপা ইসলাম প্রমূখ অভিনয় করেছিলেন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের জমিদার মির্জা সাহবে এবং তার দুই স্ত্রীকে নিয়ে নাটকের মূল কাহিনি গড়ে উঠেছিল।

হুমায়ূন আহমেদের লেখা আরও কয়েকটি ধারাবাহিক নাটক হল, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘আজ রবিবার’, ‘সবুজ সাথী’, ‘উড়ে যায় বকপঙ্খী’, ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’ ইত্যাদ। এছাড়াও এক পর্বের অনেক নাটক লিখেছেন তিনি। সেগুলোও ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার লেখা নাটকের মধ্যে ‘খেলা’, ‘অচিন বৃক্ষ’, ‘খাদক’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘অন্যভুবন’ র্দশকমনে চিরস্থায়ী হয়ে আছ। দুই পর্বের ‘কুসুম’ নাটকটি ছিল গ্রামীণ দরিদ্র পরিবার থেকে দত্তক নেওয়া এক তরুণীকে ঘিরে যে শহরে ধনীর ঘরে প্রতিপালিত হয়। শিকড়ের সন্ধানরত কুসুমের চরিত্রে সুর্বণা মুস্তাফা এখনও অবস্মিরণীয়। ‘খেলা’ নাটকে বৃদ্ধ শিক্ষক এবং অপরাজেয় দাবা খেলোয়াড়ের ভূমিকায় আবুল হায়াতের অভিনয় দর্শকের আরও অনেক দিন মনে থাকবে। ‘খাদক’ নাটকরে প্রধান চরিত্র গ্রাম্য এক দরিদ্র ব্যাক্তি যার পেশা হলো বিপুল পরিমানে খাবার খেয়ে মানুষের বিনোদন জোগানো। তিনি যখন সাধ্যের বেশি খাবার গলাধকরণের চেষ্টা করতে থাকেন, তার অনাহারী সন্তানরা তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে।

‘অন্যভুবন’ নাটকে তিনটি মাত্র চরিত্র। এ নাটকটিতে প্রথমবাররে মতো টেলিভিশনের র্পদায় আত্মপ্রকাশ করেন মিসির আলি। ‘ অন্যভুবন’ নাটকে সুর্বণা মুস্তাফা অভিনয় করেন এমন এক নারীর চরিত্রে যিনি তার মৃত প্রেমিকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলনে। মনস্তাত্বিক এই নাটকটির চিত্রনাট্য প্রশংসার দাবি রাখে। মিসির আলি ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটিও ছোট পর্দায় ব্যপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

হুমায়ূন আহমদে তার নাটকরে মাধ্যমে অনকে নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রী সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, অনকে শিল্পীকে উপস্থাপন করেছেন সর্ম্পূণ ভিন্ন মাত্রায়। আফজাল হোসনে যখন বহুব্রীহি ধারাবাহিকে বোকা ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করেন তখন তিনি রোমান্টিক নায়ক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়। তাকে দিয়ে হাস্যরসাত্মক একটি চরিত্রে সার্থক অভিনয় করানো ছিল হুমায়ূন আহমেদের নতুন চিন্তাধারার পরচিয়। আলী জাকের অভিনীত মামা চরিত্রটিও ছিল অসামান্য।

কোনো নাট্যনির্মাতা গণমানুষের জীবনে এতটা ছাপ ফেলতে পারেননি যতটা পেরেছেন হুমায়ূন আহমেদ। আজ তিনি নেই কিন্তু তারা ছায়া ফেলে গেছেন তার সৃষ্টিতে।

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন