parbattanews

একজন চাকমা কখনো বাঙালি হতে পারে না- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

Untitled-110

আমরাও যে বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত হয়ে গণবাংলার সঙ্গে এক হয়ে থাকতে চাই- মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা

(তিন)

বঙ্গবন্ধু এ দফাগুলো মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি মানবেন্দ্র লারমাকে বলেন, ‘তোরা বাঙ্গালি হইয়া যা।’ বলাবাহুল্য দাবি না মেনে নেওয়ায় তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়। এ প্রসঙ্গে মানবেন্দ্র লারমা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন-
আমি একজন চাকমা। একজন মারমা কখনো চাকমা হতে পারেনা, একজন চাকমা কখনও মুরং হতে পারে না, একজন চাকমা কখনো বাঙ্গালি হতে পারে না। আমি চাকমা। আমি বাঙ্গালি নই……..আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক। বাংলাদেশি। আপনারাও বাংলাদেশি। তবে জাতি হিসেবে আপনারা বাঙ্গালি। উপজাতীয়রা কখনও বাঙ্গালি হতে পারে না।’
২৩ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের বিভিন্ন বিধি প্রসঙ্গে আলোচনায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলেন,

“জনাব ডেপুটি স্পিকার: এখন মানবেন্দ্রনাথ লারমা বলবেন।
শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় স্পিকার সাহেব, আপনি আমাকে যে নাম ধরে বারবার ডাকছেন, আমার নাম তা নয়। আমার নাম মানবেন্দ্রনাথ লারমা নয়, আমার নাম মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা।
মাননীয় স্পিকার সাহেব,
আমাদের দেশের জন্য যে সংবিধান আমরা রচনা করতে যাচ্ছি, আপনার মাধ্যমে আজকে এই মহান গণপরিষদে দাঁড়িয়ে সেই সংবিধানের উপর আমি কিছু আলোচনা করব। কিন্তু তার আমে আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে। আমি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যাঁরা কারাগারে তিল তিল করে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, যাঁরা সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসককে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হাসি-মুখে হাতকড়া পরেছিলেন, হাসি-মুখে ফাঁসিকাষ্ঠকে বরণ করেছিলেন তাঁদেরকে।
১৯৪৭ সালের পর সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য যে কৃত্রিম স্বাধীনতা হয়েছিল, সেই কৃত্রিম স্বাধীনতার পর থেকে যেসব বীর, যেসব দেশপ্রেমিক নিজের জীবন তিলে তিলে চার-দেয়ালের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে উৎসর্গ করেছিলেন স্বাধিকার আদায়ের জন্য; যাঁরা নিজেদের জীবন উপেক্ষা করে স্বাধিকার আদায়ের পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের কথা আজকে আমি স্মরণ করছি, তাঁদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আজকে এখানে যাঁরা সমবেত হয়েছেন, যে মাননীয় সদস্য-সদস্যাবৃন্দ রয়েছেন, তাঁদেরকে আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
তারপর, আমি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি গত এপ্রিল মাসে যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছিল, সেই কমিটির সদস্য-বন্ধুদের।
সর্বশেষে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি আমাদের শ্রদ্ধেয় জননেতা, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

আজকে আমরা এই গণপরিষদ-ভবনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছি। এই ইতিহাসের পিছনে রয়েছে কত করুণ কাহিনী, কত মানুষের অঝোর ধারায় কান্নার কাহিনী, বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষের করুণ আর্তনাদ। তাই আজকে আমরা সেসব মানুষের কথা স্মরণ করে যদি বিবেকের প্রতি এতটুকু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে যাই, তাহলে এই কথাই আমরা বলব আজকে এখনো দাঁড়িয়ে যে পবিত্র শপথ আমরা নিয়েছি, সেই পবিত্র শপথ নিয়ে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যে পবিত্র দলিল আমরা দিতে যাচ্ছি, সেই পবিত্র দলিলে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা ব্যক্ত হয়েছে কিনা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা অর্থাৎ তারা যে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে চায়, সে কথা এই সংবিধানে ব্যক্ত হয়েছি কিনা।

তাই মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমি আমার বক্তব্যের মধ্যে যে কথা তুলতে যাচ্ছি, তাতে যদি কোন ভুল-ত্রুটি থাকে, তাহলে আমি তা শুধরে নিতে চাই কিন্তু আমি মনে করি, আমি আমার বিবেক থেকেই এসব কথা বলছি। আমি কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে বা কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে কিছুই বলতে যাচ্ছি না। যেহেতু আমি একজন নির্দলীয় সদস্য, যেহেতু আমি এই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষেরই একজন হয়ে আজকে গণপরিষদ ভবনে আমার মতামত প্রকাশ করতে যাচ্ছি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নিকট প্রকাশ করতে যাচ্ছি, তাই সংবিধানের উপর আমার কোন চুলচেরা ব্যাখ্যা নেই। আমার যে ব্যাখ্যা, আমার যে মত, আমার যে বক্তব্য, তার সবই দেশের প্রতি ভালবাসার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। যেভাবে আমার দেশকে ভালবেসেছি, আমার জন্মভূমিকে ভালবেসেছি, যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আমার দেশকে, আমার জন্মভূমিকে, এদেশের কোটি কোটি মানুষকে দেখেছি, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি খসড়া সংবিধানকে দেখতে যাচ্ছি।

তাই আমি খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য-বন্ধুদের বলছি যে, খসড়া সংবিধান তাঁরা গত জুন মাসে দিতে পারেননি যদিও গত জুন মাসের ১০তারিখে দেয়ার কথা ছিল। আজকে এই অক্টোবর মাসে আমাদের এই খসড়া সংবিধান তাঁরা দিয়েছেন। এই খসড়া সংবিধান আমরা জুন মাসে পাইনি সেজন্য দুঃখিত নই। অক্টোবর আর জুন মাসের মধ্যে ব্যবধান মাত্র কয়েকটি মাসের। সে জন্য আমার ব্যক্তিগত অভিমত, আমার কোন আপত্তি নাই; কিন্তু এখানে আমার আপত্তি হচ্ছে এই যে, যে কমিটিকে আমরা এ দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যনির্ধারণের ভার দিয়েছিলাম, সেই কমিটি-প্রদত্ত সংবিধান আজকে আমাদের হুবহু গ্রহণ করতে হচ্ছে।
এই পরিষদের সামনে আমার বক্তব্য হলো, আজকে খসড়া সংবিধান যদি এই গণপরিষদে এইভাবে গৃহীত হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে আমার যে আপত্তি আছে, সে আপত্তি হলো আমার বিবেক, আমার মনের অভিব্যক্তি বলছে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে কথা পুরোপুরি এই খসড়া সংবিধানে নাই। যদি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা এই সংবিধানে থাকত, তাহলে আমার আপত্তির কোন কারণ থাকত না। কিন্তু আজ আমি দেখতে পাচ্ছি, পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, মাথাভাঙ্গা, শঙ্খ, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা ও কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যাঁরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরে নিজেদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাঁরা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাঁদেরই মনের কথা এ সংবিধান লেখা হয়নি। আমি বলছি, আজকে যাঁরা রাস্তায় রাস্তায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন, তাঁদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি।
আজকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আপনারা বাংলাদেশের মেহনতী মানুষের কথা সমাজতন্ত্রের নামে, গণতন্ত্রের নামে বলে চলেছেন। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সংসদীয় অভিজ্ঞতা আমার সে রকম নেই। তবু আমার বিবেক বলছে, এই সংবিধানের কোথায় যেন গলদ রয়েছে।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
 আজকে যাঁরা কল-কারখানায় চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাঁদের রক্ত চুইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, কাগজ, প্রতিটি জিনিস তৈরি হচ্ছে, সেই লক্ষ লক্ষ মেহনতী মানুষের মনের কথা এখানে নাই।
তারপর আমি বলব, সবচেয়ে দুঃখজনক কথা হচ্ছে এই যে, আমাদের মা-বোনদের কথা এখানে নাই। নারীর যে অধিকার সেটা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত। নারীকে যদি অধিকার দিতে হয়, তাহলে পুরুষ যে অধিকার ভোগ করে, সে অধিকার নারীকেও দিতে হবে। কারণ, তারাও সমাজের অর্ধেক অংশ।

মিসেস সাজেদা চৌধুরী (এন.ই- ১৬৫: মহিলা-৩): On a point of order Mr. Speaker, Sir, উনি বলেছেন যে, নারীর অধিকার দেয়া হয়নি। আমি উনাকে দেখিয়ে দিতে পারি যে, নারীর অধিকার সম্পূর্ণরূপে রয়েছে এবং এই সংবিধানে নারী ও পুরুষকে সমান অধিকার দেয়া হয়েছে।

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: জনাব স্পিকার সাহেব, আমি মাননীয় সদস্যার যুক্তি খন্ডন করতে চাই না। তবে আমি যা বলতে চাচ্ছি, সেটা হচ্ছে এই যে, আজ পল্লীর আনাচে-কানাচে আমাদের যে সমস্ত মা-বোনকে তাদের দেহ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে, তাদের কথা এই সংবিধানে লেখা হয়নি। এই সংবিধানের সেই মা-বোনদের জীবনের গ্যারান্টি দেওয়া হয় নাই। যদি এটা আদর্শ সংবিধান হতো, যদি এটা গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক সংবিধান হত, তাহলে আজকে যারা নিষিদ্ধ পল্লীতে নিজেদের দেহ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে, তাদের কথা লেখা হত, তাদেরকে এই নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করে আনার কথা থাকত; কিন্তু তাদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের কথা, খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কথা এই সংবিধানে নাই।
এই সংবিধানে মানুষের অধিকার যদি খর্ব করা হয়ে থাকে, তাহলে আজকে ৩০ লক্ষ শহীদের কথা স্মরণ করে, অতীতের ইতিহাস স্মরণ করে আমি বলব যে, ইতিহাস কাউকে কোন দিন ক্ষমা করেনি, করবেও না- ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর।

আমরা দেখেছি ১৯৫৬ সালের সংবিধান, যে সংবিধানকে আইয়ুব খানের মতো একজন সৈনিক লাথি মেরে, গণতন্ত্রকে হত্যা করে পাকিস্তানের বুকে স্বৈরাচারী সরকার গঠন করেছিল। তারপর ১৯৬২ সালে তার মনের মতো একটি সংবিধান রচনা করে সেটাকে দেশের বুকে চাপিয়ে দিয়ে ভেবেছিল যে, তার এই সংবিধান এ দেশের মানুষ গ্রহণ করবে। কিন্তু এ দেশের মানুষ সেটা গ্রহণ করেনি।
এই সংবিধানও যদি সে ধরনের হয়ে যায়, তাহলে ইতিহাস কি আমাদের ক্ষমা করবে? তাই ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মতো, ১৯৬২ সালের সংবিধানের মতো এই সংবিধানকেও কি আমরা হতে দিব? আমার বিবেক বলছে, আমরা এমন সংবিধান চাই না। আমরা এমন সংবিধান চাই, যে সংবিধান আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য একটা পবিত্র দলিল হয়ে থাকবে। সে রকম সংবিধানই আমরা চাই। আমার যা মনের কথা, তা আমি ব্যক্ত করলাম।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
 আমরা অতীতকে ভুলতে পারি না। অতীত যত তিক্তই হোক-তাকে টেনে আনতেই হবে। অতীতকে যদি আমরা টেনে না আনি তার থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ না করি, সেই অতীতের গ্লানিকে যদি আমরা মুছে ফেলার চেষ্টা না করি, তাহলে কেমন করে আমরা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব, কেমন করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব? ভুলে মাশুল আমরা অনেক দিয়েছি, আর দিতে চাই না। আবার কেন ভুল হবে? ভুলের মাশুল আবার কেন দিতে হবে? অতীতের নেতৃবৃন্দ যে সব ভুল করেছেন, সেই ভুল আমরা যেন পুনর্বার না করি।
আমি বলছি না যে, অতীতকে আমি ধরে থাকব। অতীতের কথা আমি বলছি, তার অর্থ এই নয় যে, অতীতকে আমি ধরে থাকতে চাই। বরং ভবিষ্যৎকে কলুষমুক্ত করার জন্যই আমি অতীতের কথা স্মরণ করছি। অন্যথায়, অতীতের কথা বলবার আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নাই।
সংবিধানে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মনের কথা যদি সত্যিকারভাবে লিপিবদ্ধ হত, তাহলে আজকে নির্দলীয় সদস্য হিসেবে আমি এই সংবিধানকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে পারতাম। অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে না পারার অনেক কারণের মধ্যে এক কারণ হলো: এখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি।

মাননীয় স্পিকার,
 এই দলিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ থেকে প্রমাণ পাওয়া যাবে যে, এক  হাতে অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং অন্য হাতে সেটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
 সংবিধানের ১০নম্বর অনুচ্ছেদ এবং ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “(১০) মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।”
এবং “(২০) কর্ম হইতেছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য ও সম্মানের বিষয়; এবং “প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে ও প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী”- এই নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।”

মাননীয় স্পিকার,
 আজকে এখানে বলতে বাধ্য হচ্ছি, একদিকে হিংসাবিদ্বেষবিহীন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, আর অন্যদিকে উৎপাদনযন্ত্র ও উৎপাদন-ব্যবস্থাসমূহের মালিকানা, রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায়ী মালিকানা ও ব্যক্তিগত মালিকানা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে শোষণের পথ প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছে। আমরা এমন একটা ক্ষমতা দেখতে পাচ্ছি, যে ক্ষমতাবলে সরকার একটি লোককে এক পয়সার অধিকারী হতে দেবেন এবং অন্য একটা লোকের জন্য এক কোটি টাকার মালিকানার অধিকার রেখে দেবেন। [বাধা প্রদান]

মাননীয় স্পিকার,
তাই এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা, প্রাণের কথা এখানে প্রতিফলিত হয়নি, শ্রমিকের কথা প্রতিফলিত হয়নি, রিকশাওয়ালার কথা প্রতিফলিত হয়নি, মেথরের কথা প্রতিফলিত হয়নি। আজ এদের সবার জীবন, মেথরের জীবন, খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন অভিশপ্ত। তাদের কথা, তাদের দাবি এখানে স্থান পায়নি। এই যে অভিশপ্ত জীবন, তাদের কথা আজকে সংবিধানে নেই।
তারা যদি জিজ্ঞেস করে, “তোমরা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছ- তাতে আমাদের কথা কি কিছু লিখেছ?” এই প্রশ্নের আমরা কী উত্তর দেব?
যে মেথরেরা দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে, আজ আমরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে তাদেরকে কী আশ্বাস বাণী শোনাচ্ছি? তাদের অভিশপ্ত জীবনকে সুখী করে তোলার মতো কতটুকু আমরা দিয়েছি, সেই সংবিধানে কী প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি? কিছুই না।
আমাকে আজ বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশে যারা সত্যিকারভাবে শোষিত, নিপীড়িত, তাদের কথা এই সংবিধানে নাই, হ্যাঁ, তাদেরই কথা এই সংবিধানে আছে, যারা শোষিত নয়, নির্যাতিত নয়, নিপীড়িত নয়। [বাধা প্রদান]

মাননীয় স্পিকার,
তাই আজকে এখানে দাঁড়িয়ে বলতে হচ্ছে, প্রশ্ন করতে হচ্ছে যে, এটা কাদের সংবিধান? যদি জনগণের সংবিধান না-হয় তাহলে আমরা দেশকে কেমন করে গড়ে তুলব; দেশের মানুষকে কেমন করে ভবিষ্যৎ সুখী জীবনের নির্ভরতা দান করব? [বাধা প্রদান]

মাননীয় স্পিকার,
 আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আমাকে বারবার বাধা দেওয়া হচ্ছে। অনেক মাননীয় সদস্য আমাকে বাধা দিচ্ছেন, যার ফলে আমি আমার …….

জনাব ডেপুটি স্পিকার: আপনাকে বাধা দেয়ার ক্ষমতা কারও নেই। কোন সদস্যের অধিকার নাই আপনাকে বাধা দেয়ার। আমি আপনাকে বলছি, আপনি মন খুলে বলে যান আপনার বক্তব্য।

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: এরপর, বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতি সত্ত্বার কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতি সত্ত্বার অস্তিত্বের কথা অস্বীকার করা উচিত নয়। কিন্তু সেই সব জাতির কথা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই খসড়া সংবিধানে নাই।
আমি খুলে বলছি। বিভিন্ন জাতি-সত্ত্বার কথা যে এখানে স্বীকৃত হয়নি, সে কথা আমি না-বলে পারছি না। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী। আমি সেখানকার উপজাতীয় এলাকার লোক। সেখানকার কোন কথাই এ সংবিধানে নাই। যুগে যুগে বৃটিশ শাসন থেকে আরম্ভ করে সব সময় এই এলাকায় স্বীকৃত হয়েছিল; অথচ আজকে এই সংবিধানে সেই কথা নেই। খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি কীভাবে ভুলে গেলেন আমার দেশের কথা- পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা। এটা আমার কাছে বিস্ময়। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতীয় এলাকা। এই এলাকার সেই সব ইতিহাসের কথা, আইনের কথা এই সংবিধানে কোথাও কিছু নাই।

মাননীয় স্পিকার সাহেব                                                                                                           এই মহান পরিষদে দাঁড়িয়ে আজকে আমি আপনার মাধ্যমে একজন সরল মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছি। আমাদের এলাকাটা একটা উপজাতীয় এলাকা। এখানে বিভিন্ন জাতি বাস করে। এখানে চাকমা, মগ, ত্রিপুরা, লুসাই, বোম, পাংখো, খুমি, খিয়াং, মুরুং এবং চাক এইরূপ ছোট ছোট দশটি উপজাতি বাস করে। এই মানুষদের কথা আমি বলতে চাই।
এই উপজাতি মানুষদের কথা বৃটিশ পর্যন্ত স্বীকার করে নিয়েছিল। পাকিস্তানের মত স্বৈরাচারী গভর্নমেন্ট আমাদের অধিকার ১৯৫৬ সালের এবং ১৯৬২ সালের সংবিধানে স্বীকার করে নিয়েছিল। জানি না, আজকে যেখানে গণতন্ত্র হতে যাচ্ছে, সমাজতন্ত্র হতে যাচ্ছে, সেখানে কেন আপনারা আমাদের কথা ভুলে যাচ্ছেন?
পৃথিবীর অনেক দেশেই সমাজতন্ত্র রয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েট ইউনিয়নেও উপজাতিদের অধিকার আছে। পৃথিবীর আর একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত- আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু-রাষ্ট্র আমরা সেখানে দেখি, তাদের সংবিধানে বিভিন্ন জাতিকে অধিকার দেওয়া হয়েছে। জানি না, আমরা কী অপরাধ করেছি!
আমি যতদূর বুঝতে পারি, আপনার মাধ্যমে আমি মাননীয় সদস্যদের জানাচ্ছি, আমি একজন মানুষ। একজন মানুষ, যারা যুগ যুগ ধরে অধিকার থেকে বঞ্চিত। সেই জাতির প্রতিনিধি আমি। আমার বুকের ভিতর কী জ্বালা, তা আমি বোঝাতে পারব না। সেই জ্বালা আর কারও ভিতর নাই। সেই জ্বালার কথা কেউ চিন্তা করেনি।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
 ১৯৪৭ সালে কেউ কি চিন্তা করেছিলেন যে, পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে? জনাব মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন ““Pakistan has come to stay.” নিয়তি অদৃশ্য থেকে সেদিন নিশ্চই উপহাস ভরে হেসেছিলেন। সেই পাকিস্তান অধিকারহারা বঞ্চিত মানুষের বুকের জ্বালায়, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে।

জনাব নুরুল হক (এন.ই-১৪৭: নোয়াখালী-৩): বৈধতার প্রশ্ন। জনাব স্পিকার সাহেব, আমার বৈধতার প্রশ্ন হলো মাননীয় সদস্য বলেছেন, সংবিধানে উপজাতিদের অধিকারের কোন কথা নাই। আপনার মাধ্যমে আমি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, সংবিধানের ১৪নং অনুচ্ছেদে সকল প্রকার জাতির, কৃষক-শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহের অধিকার মেনে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁদের সর্বপ্রকার শোষণ হতে মুক্তিদানের কথা আছে। মাননীয় সদস্য ভুল তথ্য পরিবেশন করেছেন।

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: আমরা করুণার পাত্র হিসেবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসেবে। তাই মানুষ হিসেবে বাঁচবার অধিকার আমাদের আছে।

মিসেস সাজেদা চৌধুরী (এন.ই-১৬৫: মহিলা-৩): বৈধতার প্রশ্ন, জনাব স্পিকার সাহেব! শ্রীমানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা বলতে চেয়েছেন যে, সংবিধানে তাঁদের উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আমি বলব, তাঁরাও আজকে স্বাধীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির সঙ্গে তাঁদেরও একটা জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একটি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চাইতে একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া কি অধিক মর্যাদাজনক নয়?

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: আমি আমার অভিব্যক্তি প্রকাশ করছি। আমি একজন নির্যাতিত অধিকার-হারা মানুষ। পাকিস্তানের সময় দীর্ঘ ২৪ বছর পর্যন্ত একটি কথাও আমরা বলতে পারিনি। আমাদের অধিকারকে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই অধিকার আমরা পেতে চাই এবং এই চাওয়া অন্যায় নয়। সেই অধিকার এই সংবিধানের মাধ্যমে আমাদের দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মতো যাতে সেই অধিকার আমরাও পেতে পারি, সেই কথাই আজকে আপনার মাধ্যমে পরিষদের নিকট নিবেদন করতে চাচ্ছি। সেই অধিকারের কথাই আমি বলতে চাচ্ছি। মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার আমাদের দেওয়া হয়নি- যেমন দেওয়া হয়নি বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষকে।
তাই আমি আমার কথা যদি আপনার মাধ্যমে মাননীয় সদস্য-সদস্যাদের, ভাই-বোনদের কাছে পৌঁছিয়ে দিতে পারি, তাহলে আমি মনে করব, আমার অভিব্যক্তি সার্থক হয়েছে। কারণ, আমার যে দাবি, সেই দাবি আজকের নয়। এই দাবি করেছি স্বৈরাচারী আইয়ুব ও স্বৈরাচারী ইয়াহিয়ার সময়ও। আমরা রাজনৈতিক দিক দিয়ে পিছনে পড়ে রয়েছি। অগ্রসর জাতির মতো শক্তিশালী দল গঠন করে দাবি আদায় করতে পারছি না। কারণ, এতে যতটা রাজনৈতিক সচেতনতার দরকার, ততটা রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব রয়েছে উপজাতিদের মধ্যে, আমাদের মধ্যে।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
আজকে তাই কথা প্রসঙ্গে এই কথা বলতে চাচ্ছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের বদৌলতে আজকে এই বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জল-বিদ্যুতের বদৌলতেই কল-কারখানা চলছে।
অথচ সেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে শোষণ করা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে, যারা দেশকে গড়েছে, পাকিস্তানের শাসকরা তাদেরকে মানুষের মতো বাঁচার অধিকার দেয়নি।
আমার বক্তব্য হলো, আজকে আমরা এই সংবিধানে কিছুই পাইনি। আমি আমার বক্তব্য হয়তো সঠিকভাবে বলতে পারছি না; কিন্তু আমার বক্তব্যের মধ্যে অপ্রাসঙ্গিক কিছুই নাই।
আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা নিয়ে আমাদের জাতির পিতা শ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধুর কাছে যুক্ত-স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এই স্মারকলিপিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনের কথা বলেছিলাম, আমাদের উপজাতিদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলাম। জানি না। [বাধা প্রদান]

জনৈক সদস্য: মিস্টার লারমা একটি পৃথক স্বায়ত্তশাসিত এলাকার দাবি জানাচ্ছেন। এইভাবে এক দিক দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার উপর আঘাত হানা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।
শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: এই সংবিধানে আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা বঞ্চিত মানব। আমাদের অধিকার সংবিধানের বাইরের কোন কথা আমি বলতে চাচ্ছি না। আমার পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা সংবিধানে বলা হয়নি।
এই জন্য এই কথা বলছি যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটা ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমি জানি না, আমাদের কথা তাঁরা কেমন করে ভুলে গেলেন? আমরাও যে বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত হয়ে গণবাংলার সঙ্গে এক হয়ে থাকতে চাই, সে কথা কি তাঁরা ভুলে গেছেন?
আমাদের এই সংবিধানের খসড়া তৈরি করার সময় তাঁরা অন্যান্য দেশের সংবিধান দেখেছেন। তাঁরা দেখেছেন বাংলাদেশের এক কোণায় রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। কিন্তু কিসের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসকে এখানে স্থান দেওয়া হয়নি।
আমরা জানি, ইতিহাসকে বিকৃত করা যায় না। কিন্তু আমরা কী দোষ করেছি? কেন আমরা অভিশপ্ত জীবন যাপন করব? পাকিস্তানের সময়ে ছিল আমাদের অভিশপ্ত জীবন। আজকে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র হতে চলেছে। আমাদের অধিকার তুলে ধরতে হবে এই সংবিধানে। কিন্তু তুলে ধরা হয়নি। যদি আমাদের কথা ভুলে যেতে চান, যদি ইতিহাসের কথা ভুলে যেতে চান, তাহলে  তা আপনারা পারবেন। কিন্তু আমি পারি না।
উপজাতিরা কি চায়? তারা চায় স্বাধীন গণপরিষদের অধিবেশনে তাদের সত্যিকারের অধিকারের নিশ্চয়তা।

ডেপুটি স্পিকার: আপনার বক্তব্য বুঝতে পেরেছি। আমি আপনাকে অধিকারের প্রশ্নে বৈধতার প্রশ্নে কোন বক্তৃতা করতে দিতে চাই না। দয়া করে আপনি বসে পড়ুন।

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় ডেপুটি স্পিকার সাহেব, তাই আজকে বঞ্চিত মানুষের মনের কথা আমি আপনার মাধ্যমে তুলে ধরতে চাই। সেই বঞ্চিত মানুষের একজন হয়ে আমি বলতে চাচ্ছি আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের যারা নির্যাতিত সেই বৃটিশ আমল থেকে শুরু করে, সেই পাকিস্তান আমলের যে নির্যাতন ভোগ করেছি, সেই নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে চাই। আমরা চাই মানুষের মতো মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে।
এই খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটি আমাদেরকে সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন করেছেন। এই খসড়া সংবিধানে আমাদের অবহেলিত অঞ্চলের কোন কথা নাই। তাই আজকে আমি বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির কাছে কী অপরাধ করেছে, তা আমি জানি না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হলো বিভিন্ন জাতি-সত্ত্বার ইতিহাস।
কেমন করে সেই ইতিহাস আমাদের সংবিধানের পাতায় স্থান পেল না, তা আমি ভাবতে পারি না। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া, নির্যাতিত জাতিকে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।
জনাব ডেপুটি স্পিকার:  আমি অনুরোধ করছি, দু-এক মিনিটের মধ্যে আপনার বক্তব্য শেষ করলে পরিষদের কাজ মূলতবী ঘোষণা করতে পারি।

জনাব আছাদুজ্জামান খান (এন.ই -৯০: ময়মনসিংহ-১৫): জনাব স্পিকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে আমি সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, যখন স্পিকার কথা বলেন তখন কোন সদস্য যেন কথা না বলেন।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: আপনি দু-এক মিনিটের মধ্যে আপনার বক্তব্য শেষ করুন।

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমার বক্তব্য দু-এক মিনিটের মধ্যে শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না। আপনি অনুমতি দিলে আমি বলতে পারব এবং আপনি অনুমতি না দিলে আমি বলতে পারব না।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
আমি বলতে চাই যে, মানুষের কথা এই সংবিধানে সংযোজিত করতে হবে। যদি মানুষের কথা এ সংবিধানে না-থাকে, তাহলে এই সংবিধান দিয়ে কি হবে?

জনাব ডেপুটি স্পিকার: আপনার বক্তৃতার প্রায় কথাই পুনরুক্তি।

শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মাননীয় স্পিকার সাহেব, আমার বক্তৃতার কথাগুলি যদি পুনরুক্তি হয়ে থাকে তাহলে সেটা আমার দোষ নয়। আমার কথার মাঝখানে অন্য কেউ বক্তৃতা দিতে শুরু করলে আমার বক্তৃতার খেই হারিয়ে যায়।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
 আমি যে কথা একবার শেষ করতে চাচ্ছি, সেই কথা বলার মাঝখানে যদি বাধা পড়ে, তাহলে নিশ্চয়ই পুনরুক্তি হবে।
আমার কথা হলো, বঞ্চিত মানুষের কথা থাকতে হবে এবং সেই বঞ্চিত মানুষের মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ। পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসকে কেন এই সংবিধানে সংযোজিত করা হলো না? যদি পার্বত্য-চট্টগ্রামের জনগণের অধিকার স্বীকৃত না হয় তাহলে এই সংবিধান তাঁদের কি কাজে লাগবে। আমি একজন মানুষ যেখানে জন্মগ্রহণ করেছি, যে জন্মভূমিতে আজন্ম লালিত-পালিত হয়েছি, সে জন্মভূমির জন্য আমার যে-কথা বলার রয়েছে, সে কথা যদি প্রকাশ করতে না-পারি, যদি এই সংবিধানে তার কোন ব্যবস্থাই দেখতে না-পাই, তাহলে আমাকে বলতে হবে যে, বঞ্চিত মানুষের জন্য সংবিধানে কিছুই রাখা হয়নি। বঞ্চিত মানুষের সংবিধান এটা কিছুতেই হবে না, মানুষ এটাকে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করবে।
তাই আমার কথা শেষ করার আগে আমার কথাগুলিকে সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে চাই। এই সংবিধানে মানুষের মনের কথা লেখা হয়নি। কৃষক, শ্রমিক, মেথর, কামার, কুমার, মাঝি-মাল্লার জন্য কোন অধিকার রাখা হয়নি। পার্বত্য-চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণের অধিকারের কথাও সংবিধানে লেখা হয়নি।

মাননীয় স্পিকার সাহেব,
 আমার বক্তব্য শেষ করার আগে আপনার মাধ্যমে পরিষদের ভাই-বোনদের কাছে এ-কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জনাব ডেপুটি স্পিকার: আগামীকাল সকাল ৯টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবী ঘোষণা করছি।”

Exit mobile version