এবার গওহর রিজভীর হাত থেকেও ত্রাণ নিতে অস্বীকৃতি জানালো পাহাড়ীরা: পদত্যাগের হুমকি দিলেন পার্বত্য সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা

08.09.2013_Matiranga Taindong News PIC

মুজিবুর রহমান ভুইয়া, তাইন্দং (মাটিরাঙ্গা) থেকে ফিরে :

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তাইন্দং সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্থ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের চার দিনের মাথায় আজ রোববার তাইন্দংয়ের বগাপাড়া পরিদর্শণ করেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। তার সফরসঙ্গী হিসেবে দ্বিতীয় দিনের মতো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যান পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা।

এসময় পাহাড়ীদের সাথে মতবিনিময়কালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর আর্ন্তজাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী বলেন, সেদিন যে আক্রমন করা হয়েছে তা শুধুমাত্র পাহাড়ীদের উপর করা হয়নি। এ আক্রমণ আমাদের দেশের উপর হয়েছে, আমাদের বিশ্বাসের উপর হয়েছে, আমাদের আদর্শের উপর হয়েছে। এ আক্রমণ আমরা কখনো মেনে নেবনা। যারা আক্রমণ করেছে তাদেরকে আমরা রেহাই দেবনা। তাদের ঠিকানা হবে জেলখানা। আমরা তাদের রাজনীতি বন্ধ করে দেব। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তির জন্য তিনি পাহাড়ী বাঙ্গালীকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে সংগ্রাম করারও আহবান জানান।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, পুলিশ সুপার শেখ মো: মিজানুর রহমান ও খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক মো: জাহেদুল আলম প্রমুখ।

ড. গওহর রিজভী এসময় বিভিন্ন ঘটনার রেশ টেনে বলেন, সরকার সবসময় নির্যাতিত জনগনের পক্ষে ছিল, ববিষ্যতেও থাকবে। যেখানেই সাধারন মানুষ নিরাপত্তাহীনতা ভোগ করবে সেখানেই আমরা তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। তিনি পাহাড়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাঙ্গালীদের প্রতি আহবান জানান।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা তার বক্তব্যে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ সর্বাত্মক ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় সার্ভে করার কাজ শুরু করা হয়েছে। সার্ভে করা হয়ে গেলেই এবিষয়ে পরবর্তী উদ্যোগ নেয়া হবে।

ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রান বিতরণ অনুষ্ঠানে স্থানীয় পাহাড়ীদের কাছে ৩ আগষ্টের ঘটনার বিষয়ে বক্তব্য শোনেন তিনি। এসময় বক্তব্য রাখেন বাঙ্গালী বিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত ত্রাণ কমিটির আহবায়ক বকুল চাকমা, দেবব্রত চাকমা সহ কয়েকজন স্থানীয় পাহাড়ী। এসময় তিনি কয়েকজন নারী ও শিক্ষার্থীর বক্তব্য শোনেন।

এসময় তারা বলেন, আমরা সেটেলার বাঙ্গালীদের প্রতিহিংসার শিকার। আমাদের নিরাপত্তা আজ হুমকির মুখে। পার্বত্য চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আমরা যেসকল সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা তা পাচ্ছিনা। আমরা পার্বত্য শান্তি চুক্তির পুর্ণ বাস্তবায়বন চাই। বাঙ্গালীরা অপহরণ নাটক সাজিয়ে আমাদের উপর সেদিন এ হামলা চালিয়েছে। এসময় তারা সরকারী সাহায্য না পাওয়ার অভিযোগ করে গওহর রিজভীর কাছে।

এসময় পাহাড়ীরা বরাবরের মতোই অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে বসতবাড়ি নির্মান সহ যথাযথ ক্ষতিপুরণ প্রদান, অপারেশন উত্তোরণ বন্ধ করা, পাহাড়ীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত কর, বিজিবির যামিনীপাড়া জোন কমান্ডার সহ তাইন্দং এলাকা থেকে বিজিবি-কে প্রত্যাহার ও ঘটনার দিন পুলিশ প্রশাসনের নীরবতায় তাদের ক্ষোভের কথা জানায় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্ঠা ড. গওহর রিজভীকে।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো: মাসুদ করিম, মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ড. মোহাম্মদ মাহে আলম, মাটিরাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মো: মাইন উদ্দি খান ও তাইন্দং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: তাজুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হলে মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দংয়ের ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ীদের পক্ষে ত্রাণ কমিটির সভাপতি বকুল চাকমা। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর উপস্থিতিতে এবং তার হাত থেকে ত্রাণ নিতে অস্বীকৃতি জানালে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা পদত্যাগের হুমকি দিয়ে বলেন, ঘটনার পর থেকেই আমরা সরকারীভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও এখানকার পাহাড়ী জনগনের আস্থা অর্জন করতে পারিনি। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই না। অপরদিকে সচিব হিসাবে সে ব্যর্থতা আমার। তাই আমার আর এ পদে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই। আমি ঢাকায় ফিরে পদত্যাগ করবো। তিনি উপদেষ্টাকে তার জায়গায় অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

এক পর্যায়ে চাটুকার পাহাড়ী নেতারা তাদের পূণর্বাসনে করা সরকারী নানা প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সম্বলিত লিখিত চুক্তি দাবী করে বলেন, এ চুক্তি করা হলে তাদের ত্রাণ নিতে কোনো আপত্তি নেই। তাদের এ দাবী মানা সম্ভব নয় বলে জানালে ত্রাণ বিতরণে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।

এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্ঠা ড. গওহর রিজভী মাইক নিয়ে পাহাড়ী নেতাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, আমরা এতোদুর থেকে এসেছি। আপনাদের দু:খে দু:খী হয়েছি। এখন আপনারা যদি আমাদেরকে বিশ্বাস করতে না পারেন তা আমাদের জন্য বেদনাদায়ক। ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ীদের পক্ষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নিজস্ব গ্রাম প্রতিরক্ষা দল বা ভিডিপি গঠনের অনুমতি প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত নিরাপত্তা বাহিনীতে আনুপাতিক হারে পাহাড়ীদের নিয়োগ দেয়া, পূর্নবাসিত বাঙ্গালীদের জীবিকার নিশ্চয়তাসহ সমতলে ফিরিয়ে নেয়া, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন, অগ্নি-ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ন্যুনতম ১০ লক্ষ টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ৬ লক্ষ টাকা এবং ৫ বছরের জন্য রেশনিং চালু, চুরি করা বুদ্ধমুর্তি উদ্ধার, সীমানা প্রাচীরসহ পাকা বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ, পাহাড়ী শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক একটি জুনিয়র হাইস্কুল নির্মাণ, পাহাড়ীদের ওপর এ ধরনের নিপীড়নের ঘটনা স্থায়ীভাবে বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া এবং তাইন্দং সহিংসতার মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের দাবী জানানো হয়।

এ সময় স্থানীয় প্রশাসন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সম্মানের কথা বিবেচনা করে ত্রাণ নিতে অনুরোধ করলে পাহাড়ী নেতারা ত্রাণ নিতে সম্মত হন।

উল্লেখ্য যে, গত ৪ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি তাইন্দং সফরকালে ত্রাণ বিতরণ করতে গেলে স্থানীয় পাহাড়ী নেতৃবৃন্দ ত্রাণ নিতে অস্বীকার করে। ফলে ত্রাণ বিতরণ না করেই ফিরে যেতে হয় স্ংসদীয় কমিটির এ প্রতিনিধি দলকে।

এর আগে সকাল সাড়ে দশটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্ঠা ড. গওহর রিজভী বগাপাড়ার প্রবেশ মুখে বরাবরের মতোই পাহাড়ীদের মানববন্ধনের মুখে পড়েন। তিনি মানবন্ধনের শুরুর দিকেই গাড়ী থেকে নেমে মানববন্ধনে অংশগ্রহণ কারী পাহাড়ীদের সাথে কথা বলেন। এসময় ড. গওহর রিজভী তাইন্দংয়ের বগাপাড়ার এসময়ের প্রভাবশালী ফনীভুষন চাকমা-কে বগলদাবা কওর পুরো মানববন্ধন ঘুরে দেখেন এবং পাহাড়ীদের শুভেচ্চা জানান।

উল্লেখ্য যে, গত একমাসে একাধিক ভাড়াটে প্রতিনিধি দল সহ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তাইন্দং সফরকালে পরিদর্শক দলের আসার খবরে হঠাৎ করেই দোষীদের শাস্তি দাবীসহ সরকারী সহায়তা না পাওয়ার দাবী সম্বলিত প্লেকার্ড ও ফেস্টুন নিয়ে রাস্তার দু‘ধারে দাড়িয়ে গেলেও কোন সাধারন পাহাড়ীকে প্রতিনিধি দলের সাথে কোন কথা বলতে দেখা যায়নি। আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। বরাবরের মতো আজো কথা বলেছেন সেই চিরচেনা ফনী-দেবব্রত-বকুলরা।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে সাধারন পাহাড়ীরা ত্রাণ নিতে চাইলেও তারা পাহাড়ী নেতাদের বাঁধার কারণে ত্রাণ নিতে পারছেনা। তাদেরকে তাঁবু খাটিয়ে খোলা আকাশের নীচে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে কতিপয় পাহাড়ী নেতারা। আর এসবকে পুজি করে পাহাড়ী নেতারা একদিকে বানিজ্যে নেমেছে অন্যদিকে বাঙ্গালী বিরোধী প্রচারনা চালিয়ে মাঠ গরমের চেষ্ঠা করছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন