পেটের দায়ে চলছে ক্ষেত-খামারে শ্রম ও মোটরসাইকেল আয়-রোজগার!

করোনা দুর্যোগে মানিকছড়িতে নন এমপিও শিক্ষক-কর্মচারীর মানবেতর জীবন

fec-image

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারি বিধি-নিষেধে ৩ মাসের অধিক সময় স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা বন্ধ রয়েছে। ফলে মানিকছড়ি উপজেলার ১৫টি কিন্ডার গার্টেন, অননুমোদিত ৬টি স্কুল, ৬টি মাদরাসা, নন এমপিও ২টি মাদরাসা, ১টি হাই স্কুল, ২টি কলেজ ও সরকারি কলেজে খণ্ডকালীন পদে কর্মরত ৪শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী ৩-৫ মাস বেতন-ভাতা বেতন-ভাতা পাচ্ছে না! ফলে ওইসব শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবারে খেয়ে না খেয়ে দুঃসময় চলছে!

পরিবার-পরিজন নিয়ে জাতি গঠনের কারিগররা অত্যান্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছে! একমাত্র সরকারি কলেজের ৩ জন খণ্ডকালীন প্রভাষকের ২০ মাস বেতন বন্ধ রয়েছে! ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষক পেটের দায়ে মানুষের ক্ষেত-খামারে শ্রম ও ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে সংসারের আয়-রোজগারের চেষ্টা করছেন! যা অত্যান্ত অমানবিক।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার সরকারি-বেসরকারি (এমপিও, নন-এমপিও)স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার পাশাপাশি সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে(অননুমোদিত) গড়ে উঠা ১৫টি কিন্ডার গার্টেন, অননুমোদিত ৬টি স্কুল, ৬টি মাদরাসা, নন এমপিও ২টি মাদরাসা, ১টি হাই স্কুল, ২টি কলেজে খন্ডকালীন পদে কর্মরত সাড়ে ৩শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারীর জীবিকা নির্ভর। এছাড়া একমাত্র সরকারি কলেজ ও আটটি বেসরকারি (এমপিও) স্কুলে নন এমপিও ও খন্ডকালীন শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে প্রায় ৭০জন।

এসব নন এমপিও ও খন্ডকালীন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীরা দীর্ঘ ৩-৫ মাস বেতন-ভাতা পাচ্ছে না! গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্কুল-কলেজে গ্রীষ্মকালীণ বন্ধের মধ্যে দেশে বৈশ্বিক মহামারী‘করোনা’র প্রাদুর্ভাবে প্রতিষ্ঠান এখনো খোলা সম্ভব হয়নি।

ফলে ওই সমস্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে! প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার অজুহাতে কোন সুহৃদয় প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষক-কর্মচারীদের খোঁজ ও নেয়নি। ফলে দেশ ও বিশ্বে চলমান বৈশ্বিক মহামারী ও প্রাণঘাতি‘করোনা ভাইরাস’এর প্রাদুর্ভাবে গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে লোকজন।

কর্মহীন ও গৃহবন্দি সাধারণ মানুষজনকে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাহায্য-সহায়তা দিলেও (কিন্ডার গার্টেন ব্যতিত) শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ পর্যন্ত কারো হৃদয় জয় করতে পারেনি! ফলে ওইসব শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবার-পরিজনে চলছে অভাব-অনটন ও দুর্দিন! জীবনের এই চলমান দুঃসময়ে তারা না পারছে কর্ম/কাজ করতে, না পারছে কারো কাছে সাহায্য-সহায়তা চাইতে!

উপজেলার ১৫টি কিন্ডার গার্টেন এন্ড পাবলিক স্কুলে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ১শত ৭০জন। এসব প্রতিষ্ঠানে মার্চ-মে পর্যন্ত বেতন বন্ধ। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন ও পেটের দায়ে মানুষের ক্ষেত-খামারে শ্রম ও ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে সংসারে আয়-রোজগারের করছেন শিক্ষকরা!

উপজেলার সবচেয়ে বড় এবং প্রতিষ্ঠিত গিরিকলি কিন্ডার গার্টেন এন্ড পাবলিক স্কুলের পরিচালক মো. লুৎফর রহমান বলেন, গত মার্চ মাস থেকে স্কুল বন্ধ,ছাত্র/ছাত্রীর টিউশন ফি আদায় নেই। যার কারণে যথা সময়ে বেতন-ভাতা দিতে না পারলেও এখন চেষ্টা করছি।

ছদুরখীল জুনিয়র স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্রে মারমা বলেন, উপজেলার প্রত্যন্তাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির আয় খুবই সীমিত। ছাত্র-ছাত্রীদের পুরো বছরের আয় দিয়ে ৬ মাস চলাও দায়। সাতজন শিক্ষক-কর্মচারীকে জানুয়ারির পর আর কোন বেতন-ভাতা দিতে পারিনি!

বাটনাতলী উচ্চ বিদ্যালয়ের(নন এমপিও) প্রধান শিক্ষক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, স্কুলটি উপজেলার অনেক পুরানো প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও এমপিও না হওয়ার কারণে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিনিয়ত দুঃসময় বহমান! এ বছর ছাত্রছাত্রী ভর্তির যৎসামান্য আয় থেকে গত বছরের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছি মাত্র। জানুয়ারি থেকে ৯জন শিক্ষক-কর্মচারীর সকল পাওনা বকেয়া!

এছাড়া মানিকছড়ি সরকারি কলেজে কর্মরত ৩জন খণ্ডকালীন শিক্ষকের ২০মাসের (মে/২০ পর্যন্ত) বেতন-ভাতা সম্পূর্ণ বকেয়া! মানিকছড়ি পাবলিক কলেজ ও আইডিয়াল কলেজে মার্চ মাস থেকে ক্লাস পাঠদান বন্ধ থাকায় সেখানকার প্রায় ২০জন প্রভাষকদের পাঠদান ভিত্তিক সন্মানীও বন্ধ রয়েছে।

এভাবে উপজেলার কিন্ডার গার্টেনসহ সকল বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসায় মাসের পর মাস বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অত্যান্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছে!

গত ১৪ জুন চলার পথে দেখা যায় এক পরিচিত কিন্ডার গার্টেন শিক্ষক মোটরসাইকেল ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করছে! প্রথমে লজ্জায় মূখ ঢেকে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে ডেকে সান্তনা দিয়ে জিজ্ঞাস করলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং বলেন, ভাই দীর্ঘ এক যুগের অধিক স্কুলটিতে চাকুরী করছি। অথচ এই মহাদুর্যোগে প্রতিষ্ঠান প্রধান চলছে রাজারহালে, আর আমার মতো অনেক শিক্ষক এখন বাধ্য হয়ে ক্ষেত-খামারে শ্রম বিক্রি ও মোটর সাইকেল ভাড়া নিয়ে যাত্রী টানছে! এই বুঝি মানবতা!

এ প্রসঙ্গে উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. আতিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও অমানবিক বটে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সরকারি কলেজ পরিচালনা পর্ষদ সভাপতি তামান্না মাহমুদ একমাত্র সরকারি কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষকের বকেয়া বেতন-ভাতা সর্ম্পকে বলেন, প্রিন্সিপাল কমিটিকে না জানিয়ে খণ্ডকালীন প্রভাষক নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া সঠিক না হওয়ায় এদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। মানবিক কারণে এখন তাদের অভ্যন্তরীণ নিয়োগ প্রক্রিয়া বৈধ করে বিষয়টি সুরাহা (বকেয়া পরিশোধ) করার চেষ্টা চলছে।

এছাড়া ইতোমধ্যে ত্রাণ-সহায়তার আওতায় কিন্ডার গার্টেন শিক্ষকদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। এখনো যারা ত্রাণ-সহায়তা না পেয়ে দুঃখ-কষ্টে আছে, তাদেরকে ‘করোনা’র দুর্যোগকালীন সহায়তা দেয়া হবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন