parbattanews

কাপ্তাইতে কোনো ভিআইপি ভিজিট হলে খাদ্য তালিকায় বন মোরগের মাংস অন্তর্ভূক্ত করতে হতো

( ২১ )

কাপ্তাই এর শুক্কুর চেয়ারম্যানের অভিনব গল্প শুনাবো আজ। এমন মজার এবং অশ্রুতপূর্ব গল্প বলার আগে কাপ্তাইতে দু’জন মহান ব্যক্তির আগমনের বিষয়ে অবহিত করবো। তিরাশি/ চুরাশি সালের গল্প। ওআইসি মহাসচিব হাবিব শাত্তি- সম্ভবত আলজেরিয়ার মানুষ, সস্ত্রীক কাপ্তাই পরিদর্শনে আসেন।

আমার ব্যাটালিয়ানের রিয়ার হেডকোয়ার্টার কাপ্তাইতে লোকেটেড ছিলো বলে কাপ্তাই অফিসার্স মেসের মেস কমিটির প্রেসিডেন্ট আমি ছিলাম। পূর্বে বলেছি কাপ্তাই বক্সহাউজে আমার পরিবারের বাসস্থান ছিলো।

এই বক্সহাউজগুলো আমেরিকান কোম্পানির কর্মকর্তাদের জন্য ষাটের দশকে তৈরী করা হয়েছিলো যখন কাপ্তাই ড্যাম নির্মাণ করা হয়। এই বক্সহাউজ থেকে পূর্বে তাকালে কাপ্তাই এর দক্ষিণে বিস্তৃত পাহাড়ের সারি নজরে আসে। প্রায় প্রত্যেক দিন বিকেলে পাহাড়ের ঢালে কখনো একটা , কখনো জোড়ায় মায়া হরিণ চরতে দেখতাম। এই দৃশ্য ভোলার মতো নয়।

পাহাড়ের ঢালে সবুজ ঘাসে বিকেলের সোনালী রোদের আভায় উদ্ভাসিত বনানীতে চারণরত মায়া হরিণ দেখে এটাই মনে হতো বন্যরা সত্যিই বনে সুন্দর।

কাপ্তাই অফিসার্স মেসের প্রেসিডেন্ট এবং কাপ্তাই ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং অফিসার ( সিও ) হিসাবে ওআইসি মহাসচিব হাবিব শাত্তির কাপ্তাই ভিজিটের সব দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়। কাপ্তাইতে যত ভিভিআইপি / ভিআইপি ভিজিট হতো পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্য কোনো স্থানে হতো না। এর কারণ সম্ভবত একটাই, দেশে বিদেশে সবাই জানতো কাপ্তাই ঐসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিলো ভ্রমণের জন্য। তদুপরি কাপ্তাই ড্যাম, কাপ্তাই এর টার্বাইন উৎপাদিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং কাপ্তাই লেকে নৌভ্রমণ এবং কর্ণফুলী পেপারমিলে কাগজ উৎপাদনের প্রক্রিয়া স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা সবাই উপভোগ করতে চাইতো।

যেহেতু কাপ্তাই লেকের শুরুটা এখানে তাই এর আকর্ষণ অন্য স্থানের তুলনায় অনেক বেশী ছিলো। যখনই কাপ্তাইতে কোনো ভিআইপি/ ভিভিআইপি ভিজিট হতো তখনই খাদ্য তালিকায় বনমোরগের মাংস অন্তর্ভূক্ত করতে হতো পার্বত্য চট্টগ্রামের স্পেশাল আইটেম হিসাবে। এই বনমোরগের মাংস জোগাড় করাটা ছিলো আমার জন্য একটি মহা ঝামেলার কাজ।

দেশের ভিআইপিদের জন্য বনমোরগের মাংসের যোগান দেওয়া ছিলো ফরজে আইনের মতো। ওটা চাইই। ক্যাপ্টেন সুনিল ছিলো অফিসার্স মেস সেক্রেটারী, তার উপরে চাপ পড়তো বেশী। তবে ক্যাপ্টেন সুনিলের উদ্ভাবনী বুদ্ধি ছিলো চমৎকার। হাবিব শাত্তির ভিজিটের সময় সে “ফিশ কাপ্তাই” নামে কাপ্তাই লেকের রুই মাছের এক নতুন আইটেম অন্তর্ভূত করে ম্যানুতে।

বিদেশী ভিভিআইপি ভিজিটের সময় আমরা ক্যাটারিং এর সব কাজ চিটাগাং এর হোটেল আগ্রবাদকে দিতাম। শুধু ফিজিক্যাল ভিজিট এবং কালচারাল প্রোগ্রাম আমরা এরেঞ্জ করতাম। হাবিব শাত্তি একরাত কাপ্তাইতে ছিলেন । সব ভিজিটে কাপ্তাই পদাতিক ব্রিগেডের সব রকম সহযোগিতা ও সহায়তা আমরা সবসময় পেতাম।

হাবিব শাত্তির ভিজিটের পরে সম্ভবত কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়্যারে ইলিয়ট ট্রুডো কাপ্তাই এবং রাঙ্গামাটি ভিজিটে আসেন। এটা ছিলো একদিনের ভিজিট। তিনি এবং তাঁর এন্ট্যোরাজ ঢাকা থেকে সম্ভবতঃ হেলিকপ্টারে রাঙামাটি আসেন। ববরাবরের মতো পিয়্যারে ট্রুডোর ভিজিটও আমি কন্ডাক্ট করি।

এই ভিজিট মনোগ্রাহী করতে আমরা সব প্রোগ্রাম কাপ্তাই লেকের ছোট ছোট আইল্যান্ডে এরেঞ্জ করেছিলাম একেবারে সামরিক ফ্যশানে। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো এবং তাঁর সফর সঙ্গীদের বসার, কালচারাল প্রোগ্রাম দেখার এবং খাবারের সব ব্যবস্থা তাঁবুতে এরেঞ্জ করেছিলাম। এক এক প্রোগ্রাম এক এক আইল্যান্ডে।

কাপ্তাই লেকে ভ্রমণের জন্য আর্মির স্পিডবোট ব্যবহার করেছিলাম আমরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভিআইপি এবং ভিভিআইপি ভিজিট প্রোগ্রামে কালচারাল প্রোগ্রাম করা হতো পার্বত্য জেলাত্রয়ের উপজাতি শিল্পীদের দিয়ে। এতে থাকতো নাচ- যেমন থালা নৃত্য, বোতল নৃত্য, বাঁশ নৃত্য এবং স্থানীয় ভাষায় গান।

কানাডার প্রধানমন্ত্রীর জন্য কালচারাল প্রোগ্রামও রাঙামাটির কালচারাল ইনস্টিটিউট এবং অন্য পার্বত্য জেলার শিল্পী সমন্বয়ে এরেঞ্জ করেছিলাম। দুপুরে লাঞ্চের সময় আমি প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে ইলিশ মাছের আইটেমের প্রতি তাঁর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বললাম এটা আমাদের জাতীয় মাছের আইটেম।

তিনি সম্ভবত আমাদের খুশী করার জন্য ইলিশ মাছের একটি টুকরা মুখে দিয়ে ভীষণ বেকায়দায় পড়ে গেলেন। খালি বলছিলেন “ইটস টেস্টি বাট বোনি”। তাঁর এই উক্তি আমার এখনও মনে আছে।

একটা বিষয় আমার মনে ধরে আছে, তাহলো প্রধানমন্ত্রী পিয়্যারে ইলিয়ট ট্রুডোর সাথে সামান্য কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে আমার মনে হয়েছে তিনি যেন কত দিনের পরিচিত আমাদের। কোন বাহুল্য নাই, কোন বাড়তি আড়ম্বর নাই সহজ সরল যেন কত আপনজন। তাঁর এই শিক্ষা আমি কোনোদিন ভুলবো না ।

এবারে শুক্কুর চেয়ারম্যানের গল্পে ফিরে আসি। শুক্কুর চেয়ারম্যানের নাম আমি কাপ্তাইতে এসে জানতে পারি। শক্কুর চেয়ারম্যান চট্টগ্রামের মানুষ। কাপ্তাইতে এসে প্রথমে লঞ্চঘাটে শ্রমিকের কাজ নেয় সে। এটা কবেকার কথা আমার জানা নাই। শুক্কুর চেয়ারম্যান হয় কাপ্তাই ইউনিয়নের এবং এর পরে শুক্কুরের নামের সাথে চেয়ারম্যান নামটি যুক্ত হয়ে যায়। সে পরিচিতি পায় শুক্কুর চেয়ারম্যান হিসেবে।

পরে কাপ্তাই উপজেলা হলে এই শুক্কুর চেয়ারম্যান কাপ্তাই এর প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যানও হয় এই শুক্কুর চেয়ারম্যান । তবে কাপ্তাই এর মানুষকে শুক্কুর চেয়ারম্যানকে শুক্কুজ্যা বলে ডাকতে শুনেছি। প্রথম উপজেলা নির্বাচনে শুক্কুর চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হয়েছে। শহরময় তার নির্বাচনী পোষ্টারের ছড়াছড়ি। সেটা বড় বলে আমার কাছে মনে হয় নাই। আমার কাছে শুক্কুর চেয়ারম্যানের নির্বাচনী প্রচারণার একটি ঘটনা যা আমাকে আজও ভাবিত করে সেই ঘটনার কথা এখন বলছি। তবে শুনুন।

আমি একদিন কোনো এক কাজ শেষে সন্ধ্যার দিকে কাপ্তাইতে আমার বাসা বক্সহাউজে ফিরছি। কাপ্তাই শহরের প্রধান রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় দেখলাম হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে বসে আছে। মাইকে সমানে ঘোষণা করা হচ্ছে ভাই সব একটু ধৈর্য্য ধরেন, এই একটু পরেই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিবিসি বাংলাতে আমাদের প্রাণ প্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী পরীক্ষিত জনদরদী নেতা গরীবের বন্ধু জনাব শুক্কুর চেয়ারম্যানের উপরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রচারিত হবে।

আমি ড্রাইভারকে জিপ থামাতে বললাম। জিপ থেকে নেমে সমাবেশের কাছে গিয়ে দেখলাম একটি বড় রেডিও কাম ক্যাসেট প্লেয়ার একটি টেবিলের উপরে বসানো এবং সামনে মাইকের স্পিকার স্ট্যান্ডে ক্যাসেট প্লেয়ারের দিকে রাখা। আমি বিবিসির প্রচার শোনার জন্য দাঁড়ালাম। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হলো।

তখন বিবিসিতে অনুষ্ঠান প্রচারের পুর্বে বাঁশিতে সূর বাজতো। বিবিসির বাঁশির সূর বাজলো। অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হলো। প্রথমে বিশ্ব সংবাদ শেষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দেয়া হলো। বিশ্ব সংবাদ শেষ হলো যথাসময়ে। এর পরে শুরু হলো শুক্কুর চেয়ারম্যানের উপরে বিবিসির বিশেষ অনুষ্ঠান। বিবিসির ঘোষণাটি ছিলো এইরূপ:

এখন প্রচার করা হচ্ছে কাপ্তাই উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব জনাব শুক্কুর চেয়ারম্যানের উপরে একটি বিশেষ প্রতিবেদন”। প্রায় পনেরো মিনিটের এই বিশেষ প্রতিবেদনে শুক্কুর চেয়ারম্যানের কর্মকান্ডের উপরে একটি চমৎকার প্রতিবেদন পরিবেশিত হলো। বিবিসির সমস্ত পরিবেশনাটি ছিলো নিখুঁত এবং বাহুল্য বর্জিত। বাসায় ফিরে চিন্তা করলাম এটা কি করে সম্ভব? শুক্কুর চেয়ারম্যানের উপরে বিবিসি বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করবে তা কি করে হয়?

উপজেলা নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হলো। শক্কুর চেয়ারম্যান বিপুল ভোটে কাপ্তাই উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিতও হলো। শেষে আমার আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। পরে জানা গিয়েছিল শক্কুর চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম থেকে এক্সপার্ট দিয়ে বিবিসির বিশেষ এই প্রতিবেদনটি তৈরী করেছিলো যা ছিলো একটি সম্পূর্ণ ভূয়া প্রতিবেদন। মানুষকে বিভ্রান্ত করার শুক্কুর চেয়ারম্যানের এই কৌশল আমাকে আজও বিমোহিত করে। তবে আমি তার বুদ্ধির তারিফ করি। একটা মানুষ শ্রমিক থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছেন এমন নজির অনেক হয়তো আছে তবে শুক্কুর চেয়ারম্যান আলাদা এটা মানতে হবে।

জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর।

Exit mobile version