কার নিয়ন্ত্রণে রোহিঙ্গা শিবির?

fec-image

কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আছে। এর মধ্যে ২৩টি ক্যাম্প উখিয়ায়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অধিকাংশ রোহিঙ্গা এসব ক্যাম্পেই আছেন। এখানে প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসতি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাম্প কুতুপালংয়ে আছে তিন লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। আর ক্যাম্পগুলোতে আধিপত্য বিস্তার নিয়েই একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে এখানকার রোহিঙ্গা-সন্ত্রাসীরা।

গত চার বছরে ৮২ রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় ৮০টি মামলা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা আরও ১০ রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করলেই হত্যা করা হয়।

ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ড ও অস্থিরতার জন্য জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করছেন নিহতের স্বজনরা।

কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতি আছে। তাদের কঠোরভাবে দমন না করলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

২৯ সেপ্টেম্বর কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়ায় রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়। এক মাস না যেতেই ২২ অক্টোবর ভোররাতে উখিয়ার বালুখালী এফডিএমএন ক্যাম্প-১৮-এর এইচ-৫২ ব্লকে ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়াহ’ মাদ্রাসায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এতে মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক ও ভলানটিয়ারসহ ছয় রোহিঙ্গা নিহত হন। দুই ক্যাম্পের দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। রোহিঙ্গাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মূলত ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় সন্ত্রাসীরা।

রোহিঙ্গারা বলছেন, আরসাকে মদত দিচ্ছে মিয়ানমার। ওরা এজেন্ট হিসেবে প্রত্যাবাসন বিরোধিতায় কাজ করছে। ক্যাম্পের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোতে আরসার হাত আছে। তারা আরও প্রশ্ন তোলেন, প্রশাসনের চোখের সামনে কীভাবে ঘটছে এ হত্যাকাণ্ড? ক্যাম্পগুলো কী প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে?

এমন দাবি মানতে নারাজ ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) পুলিশ সুপার (অধিনায়ক) মো. শিহাব কায়সার খান। তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পগুলো প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে। দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। ক্যাম্পগুলোতে অপরাধীদের হাতে যে অস্ত্র রয়েছে, সেগুলো দেশি। এসব দিয়ে ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণের শক্তি রাখে না তারা। ছয়জন নিহত হলেও তাদের শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে অন্যদের ভয় দেখাতে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

নাম জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বালুখালী ক্যাম্পের একাধিক রোহিঙ্গা জানান, ‘সন্ত্রাসীদের ক্ষোভ সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর। কেননা শান্তিপ্রিয় রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দেয়। সন্ত্রাসীদের ধরতে পুলিশকে সহযোগিতা করে। এ জন্য তারা ক্ষুব্ধ। তারা হুমকি দিচ্ছে, সবাইকে শেষ করে দেবে। এ জন্যই আতঙ্কে আছি আমরা। এখানে সন্ত্রাসীদের এজেন্ট আছে। ক্যাম্পগুলো তাদেরই নিয়ন্ত্রণে বলা যায়।’

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত টেকনাফ ও উখিয়া থানায় ৮২ রোহিঙ্গাকে হত্যার অভিযোগে ৮০টি মামলা হয়েছে। এর বাইরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উখিয়া-টেকনাফ থনায় এক হাজার ৩৬৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দুই হাজার ৩৪৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে এক হাজার ৭৪৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দায়ের হয়েছে মাদক মামলা (৭০৬টি)।

‘প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বললেই খুন’

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াসহ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি মাস্টার মুহিবুল্লাহ নামে পরিচিত ছিলেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। দেখা করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও। দুই বছর আগে ক্যাম্পের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে সমাবেশ করার পরই রোহিঙ্গা নেতা হিসেবে তার নাম সবার সামনে আসে। রোহিঙ্গাদের কাছে তিনি জনপ্রিয়ও ছিলেন। পুলিশ ও ভুক্তভোগীর পরিবার বলছে, প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করতে গিয়েই খুন হন মুহিবুল্লাহ।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, মুহিবুল্লাহর আগেও প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করা ১০ রোহিঙ্গা নেতা খুন হয়েছিলেন। গত ১৬ মে লম্বাশিয়ায় শওকত আলী নামে এক রোহিঙ্গা নেতা খুন হন। তার আগে খুন হন মো. আরিফ উল্লাহ, মো. হাশিম ও মাওলানা আবদুল্লাহ। তারা সবাই প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করেছিলেন।

এআরএসপিএইচ’র নেতা আবদুর রহিম বলেন, ‘এসব ঘটনা প্রত্যাবাসনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও অনেকে এখন কাজ করতে চায় না। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি আমরা।’

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয়। আরসার পাশাপাশি আল ইয়াকিন, আরএসও ও ইসলামি মাহাতও আছে। এর পাশাপাশি সিভিল রাইটস ও মানবাধিকার ইস্যুতেও আন্দোলন করছে কিছু সংগঠন।

পুলিশ বলছে, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার ও মতাদর্শগত বিরোধ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। মাদক, পাচার, অপহরণ, খুন ও ধর্ষণসহ ১২ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে অনেক রোহিঙ্গা।

মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল জোরদার থাকার পরও কীভাবে ছয় জনকে হত্যা করা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ক্যাম্পগুলো ঘিঞ্জি। অপরাধীরা এই সুযোগটাই পেয়েছে। তবে তারা পার পাবে না। পার পায়নি মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িতরাও।’

তিনি বলেন, ‘ছয় খুনের বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা ক্যাম্পগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি। পুলিশ নিয়মিত টহল দিচ্ছে। ক্যাম্প এলাকায় অভিযান অব্যাহত আছে।’

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘পরিস্থিতি অশান্ত করতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পগুলো পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় অস্ত্রধারীদের ধরা কঠিন। এদের গ্রেফতার করা না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। যৌথ অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতারের দাবি জানাই।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কার, নিয়ন্ত্রণে, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন