কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে লাঙল-জোয়ালের সোনালি অতীত

fec-image

কৃষক মাঠে গলা ফাটিয়ে গান গেয়ে জমিতে লাঙল চালিয়ে চাষাবাদের সেই দৃশ্যের দেখা পাওয়া আজ বড়ই দুষ্কর। হয়তো একদিন গ্রাম বাংলার এই হালচাষ পদ্ধতি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই শোনাবে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামীণ ঐতিহ্যর মধ্য হারিয়ে যেতে বসেছে মানব সভ্যতার সোনালি অতীত, বীর বাঙালির চিরচেনা ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের হাল চাষ তথা লাঙল-জোয়াল।

রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের যেমন- বাঙালহালিয়া, গাইন্দ্যা, ও ঘিলাছড়ির ইউনিয়নে ঘুরে দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী গরু-মহিষের হাল চাষ অনেকটা কম গেছে, নেই বললেই চলে। আধুনিকতার ছোয়াঁ পেয়ে কৃষি যন্ত্র দিয়ে চাষাবাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে।

এ বিষয়ে বাঙালহালিয়া ইউনিয়নের মারমা অধিষ্যুত কাকড়াছড়ি এলাকার প্রবীণ কৃষক সামুচাই মারমা বলেন, আমার বাপ-দাদারা বড় বড় গরু-মহিষ দিয়া আগে জমি চাষ (হাল চাষ) করতেন, বাড়িতে জমি চাষের বলদ গরু ছিল ৪ থেকে ৫ জোড়া। জমি হাল চষতে (চাষের) লাগতে এক জোড়া বলদ, কাঠের তৈরি লাঙল, বাঁশের তৈরি জোয়াল, মই, বাঁশ দিয়ে তৈরি গরুর মুখে তুরি এইসব। তা বর্তমানে আর নাই। আমি এখনো মাঝে মাঝে অল্প-স্বল্প করি। কারণ বসে থাকতে ভালো লাগে না। সময়মতো মেশিন পাই না তাই বীজ রোপণ (জমিন) গরু দিয়া একটু চাষ করি। এখন তো মানুষরা কাজ মেশিন দিয়ে করে।

গাইন্দ্যা ইউনিয়নের হাজি পাড়া গ্রামের জালাল উদ্দিন বলেন, আগে ফজরের নামাজ পরে গরু নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে জমির দিকে গেলেই দেখা যেত অনেক কৃষক। কিন্তু আস্তে আস্তে ইঞ্জিন চালিত ট্রাক্টর সব দখল করেছে। গরু দিয়ে হাল চাষের কদর কমে গেছে। আগে মানুষের বাড়িতে গরু-মহিষ দিয়া ধান মাড়াই করত। এখন ডিজিটাল মাড়াই মিশিন দিয়া লয়। সে আগের মানুষও নাই যে হাল চাষ করবে, আমার নিজের জমি মেশিন দিয়া জমি চাষ করি, আর মাড়াই মিশিন দিয়া ধান নিই।

প্রতিনিয়ত নতুন কৃষি যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে সারাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে হাজার বছরের বাঙালির চিরচেনা সেই গরু-লাঙল দিয়ে জমি চাষের চিত্র। তাই আর সকালে কাঁধে লাঙল-জোয়াল নিয়ে মাঠে যেতে দেখা যায় না কৃষকদের। গরু দিয়ে হালচাষের পরিবর্তে এখন ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করা হয়। আগেরকার সময় গবাদিপশু দিয়ে হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন অনেকে। ধান, ডাল, তিল, বাদাম, মরিচ, আলু, বেগুন, মুলা ও ঢেরস চাষের জন্য ব্যবহার করতেন। নিজের সামান্য জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন।

এ বিষয়ে রাজস্থলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনি বলেন, এককালে দেখেছি কৃষকরা কাঁধে জোয়াল ও হাতে গরুকে পিঠানো বেত এবং লাঙ্গল ও পান্তা ভাতের বাটি। কিন্তু কালের আবর্তে সব হারিয়ে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সরকার উন্নয়নে বিভিন্নযন্ত্রপাতি দিয়ে আজ জমি চাষ করে ফলন উৎপাদন করছে। গরু দিয়ে হাল চাষ গ্রামীণ সমাজের কৃষকদের একমাত্র অবলম্বন ছিল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন তা বিলুপ্তির পথে। আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে গরুর-লাঙলের চাষ গভীর হত। গরু দিয়ে চাষ করার সময় গরুর গোবর জমিতেই পরতো তাতে জৈবসার হতো, জমির ফসল ভালো হতো। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশক কম লাগতো। দিনদিন ধীরে ধীরে এভাবেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে মানব সভ্যতার সোনালি অতীত লাঙল-জোয়াল।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন