কিশোরীর ইজ্জতের দাম ৫০ হাজার : পার্বত্য নিউজে দুইটি রিপোর্ট প্রকাশের পর টনক নড়েছে পুলিশ ও নেতাদের
আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
এক কিশোরীর ইজ্জতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। গরিব ও নিরীহ হওয়ায় সম্ভ্রম খুইয়েও আইনের সাহায্য পায়নি এই কিশোরীর পরিবার। তবে আইনি প্রক্রিয়া আটকে রেখে শালীশের মাধ্য বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। লংগদু উপজেলার রাঙ্গীপাড়ার বাসিন্দা এই হত দরিদ্র পরিবারকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে থানায় করা অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ার চাপ দিচ্ছে এই নেতারা। এদিকে স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে শালিস করলেও টাকা পরিশোধ করা হবে এক মাস পর। জরিমানা বাকি রেখেই সমঝোতার চেষ্টা করছে এই নেতারা। আর স্থানীয়ভাবে সমাধানের কথা বলে মামলা আটকে রেখেছে চারদিন।
তবে লংগদু থানার অফিসার জানিয়েছে আজ বৃহস্পতিবারের ডেটে মামলা রেকর্ড করা হয়েছে মামলা নং ৭। স্থানীয়রা বলছে ঘটনার চারদিন পর বিষয়টি তদন্তে গেছে পুলিশ। গত ১৮ আগষ্ট রবিবার রাংগামাটি জেলার লংদুতে রাংগীপাড়া গ্রামে রাংগীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষন এবং পরে প্রভাব খাটিয়ে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার বিষয়ে এলাকায় ক্ষোভ বিরাজ করছে।
মামলা করার পরও তদন্ত না করায় এবং দরিদ্র পরিবারের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করায় গত ১৯ আগস্ট পার্বত্য নিউজে এ বিষয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। রিপোর্ট প্রকাশের পরও পুলিশ মামলার তদন্তে না গিয়ে রিপোর্টকারী সাংবাদিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এবং বিষয়টি একবারে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বুঝে শালিশের মাধ্যমে ক্ষতিপুরণ দেয়ার নাম করে অপরাধীকে বাঁচানো চেষ্টা করে। ফলে ২১ আগস্ট পার্বত্য নিউজ আরেকটি রিপোর্ট করলে থানা পুলিশের টনক নড়ে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভিকটিমের বাবা মোবারক আলী জানান, ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার মধ্যস্থতায় এক গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে ধর্ষনের অভিযুক্ত শাহ আলম এর নিকট থেকে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা ধার্য্য করে ঘটনাটি স্হানীয়ভাবে মীমাংসা কয়া হয়। যা আগামী একমাস পর পরিশোধ করা হবে।
গত মঙ্গলবার সন্ধায় রাংগীপাড়া গ্রামে সালিশীর আয়োজন করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তিনি আরোও জানান, ঘটনার দিন বিকেলেই লংগদু থানায় মামলা করার পরও আজো পুলিশ কোন প্রকার তদন্ত করেনি কিংবা ধর্ষককে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেননি। গ্রাম্য বিচার মানলেন কেন- জানতে চাইলে ধর্ষিতার মা বলেন “আমরা গরিব মানুষ, থানা পুলিশে খরচ করার মত সামর্থ্য নাই তাই একরকম বাধ্য হয়েই বিচার মাইন্যা লইছি।’ তবে উক্ত ঘটনায় অপরাধির সুষ্ট বিচার হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন অনেক গ্রামবাসী। তারা এই ঘটনার সুবিচার দাবী করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, এই সালিশী বৈঠকের নেতৃত্ব দেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আব্দুল বারেক সরকারের চাচাত ভাই একই কমিটির সহ-সভাপতি সেলিম মেম্বার। তিনি নিজে সরকারদলীয় কয়েকজন ছাত্র ও যুব নেতাকে সাথে নিয়ে এই সালিশী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানাগেছে।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে সেলিম মেম্বার সালিশী বৈঠকের সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে বলেন, এটা সামান্য একটা ঘটনা ধর্ষণের মতো কোনো ঘটনা নয়। প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে সামান্য ঘটনার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করলেন কেন? এমন প্রশ্ন করা হলে এড়িয়ে গিয়ে সেলিম মেম্বার জানান, ভাই আমি এটা জরুরি কাজে ব্যস্ত আছি, আপনি আমাকে আধা ঘন্টা পরে ফোন দেন। পরে দীর্ঘক্ষণ চেষ্টা করেও তার মোবাইলে যোগাযোগ করা যায়নি। কল করলে মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ রয়েছে বলে জানানো হয়েছে অপারেটরের পক্ষ থেকে। পরে লংগদু থানার সিলেটি সমিতি নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে দিয়ে ফোন করে প্রতিবেদককে রিপোর্টটি না করার জন্য অনুরোধ করে এই ব্যাপারে আলোচনার প্রস্তাব দেন।
সংশ্লিষ্ট এলাকা বগাচত্তর ইউনিয়নের এক নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোঃ মনসুর আহম্মেদের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনা ঘটার এক ঘন্টা পরে আমি ঘটনাস্থলে যাই এবং ভিকটিমসহ তার পিতা-মাতাকে লংগদু থানায় আইনগত সহযোগিতা নেওয়ার জন্য পাঠাই। এরপর নিজের ব্যক্তিগত কাজ থাকায় আমি লংগদু হয়ে রাঙামাটি শহরে চলে আসি। পরে মঙ্গলবার দিবাগত রাত বারটার সময় আমি এলাকা থেকে সংবাদ পাই যে, এই ঘটনায় একটি শালিসী বৈঠক হয়েছে। যাতে সিদ্ধান্ত হয় যে, অভিযুক্ত শাহ আলমের পরিবারের কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে আগামী একমাসের মধ্যে ভিকটিমের পরিবারকে দেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে বসার কথা বললে আমি রাজি হইনি এবং এটাও বলেছি বিষয়টি যে পর্যায়ে গেছে এটা নিজেরা বসে মিমাংসার পর্যায়ে নেই।
এদিকে লংগদু থানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, এটা ধর্ষণের ঘটনা নয়, সামান্য হাত ধরে টানাটানির ঘটনা। এটা সামাজিকভাবে মিমাংসা করার কথা বলায় আমরা বেশিদুর এগুইনি। সালিশে কেন পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাছে এমন কোনো তথ্য নেই, তারপরেও আপনার কাছ থেকে যখন তথ্য পেয়েছি আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ঘটনাটি যে ইউনিয়নে ঘটেছে সেই ইউনিয়ন বগাচত্তরের চেয়ারম্যান আব্দুল গাফফার ভূইঁয়া জানিয়েছেন, আমি ঘটনাটি শুনেছি। আমার কাছে কেউ কোনো ধরনের অভিযোগ না করায় এব্যাপারে আমি আর কোনো খবর নেইনি।
এদিকে উক্ত ঘটনার তদন্তকারি কর্মকর্তা লংগদু থানার এসআই ইব্রাহিম জানান, এলাকায় তদন্ত করতে এসে আমি জেনেছি যে, অভিযুক্ত মোঃ শাহ আলম বখাটে টাইপের ছেলে। আর এটা ধর্ষণের ঘটনা নয়, অনেকটা শ্লীলতাহানীর মতো। আমি বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে তদন্ত করে দেখছি যদি তেমন কিছু পাই তাহলে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লংগদু থানার সিলেটি সমিতি নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে দিয়ে ফোন করে প্রতিবেদককে রিপোর্টটি না করার জন্য অনুরোধ করে এই ব্যাপারে আলোচনার প্রস্তাব দেন।