parbattanews

কী এমন ঘটলো যারা উপজাতি ছিলেন এখন নিজেদের আদিবাসী দাবী করছেন- বিবিসিকে এইচটি ইমামের প্রশ্ন

13873021_1015122358585620_5073639575022944475_n

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতলের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বসবাস করেন তারা আদিবাসী কিনা সে বিতর্ক বেশ পুরনো। প্রতিবছর বিশ্ব আদিবাসী দিবস সামনে আসলে সে বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা এবং সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করেন, যেটি দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২%।

আদিবাসী শব্দটি নিয়ে যখন বিতর্ক আর অস্বস্তি, সেই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও মঙ্গলবার পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’।

জাতিসংঘের ঘোষিত এই দিনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন উদযাপন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দটির অস্তিত্বই স্বীকার করেনা।

বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়, তারাই ‘আদিবাসী’।

ঐ অঞ্চলে যেসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি বসবাস করছে তারা আসলেই সেখানকার আদিবাসী কিনা এনিয়ে রাজনৈতিক মতভেদ যেমন আছে তেমনি নৃবিজ্ঞানীদের মাঝেও আছে বিভক্তি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড: সাইফুর রশিদ বলেন, আমরা নৃ গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করি কতোগুলো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে। নিজস্ব ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতি এইগুলোর ভিত্তিতে আমরা এথনিক কমিউনিটিকে চিহ্নিত করতে পারি। আদিবাসীকে চিহ্নিত করার যে মাপকাঠি রয়েছে সেগুলো হচ্ছে, দীর্ঘদিন বা শতশত বছরের পরিক্রমায় যদি চিহ্নিত হয় যে এই জনগোষ্ঠী এই ভূখন্ডে প্রথম এসেছে সেটার ভিত্তিতে আদিবাসী চিহ্নিত করতে হবে। সে হিসাবে সকল নৃগোষ্ঠীই আদিবাসী নয়। কোন কোন নৃগোষ্ঠী হয়তো আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে”।

অধ্যাপক রশিদ বলেন, বর্তমান বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডে বাঙালীরাও ছিল এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীও এ অঞ্চলে এসেছে। তিনি বলেন, কে আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত হবে সেটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই।

অধ্যাপক রশিদ বলেন, “কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কোন অধিবাসী আগে এসেছে, সেটার ভিত্তিতে বাংলাদেশের আদিবাসী বলাটা কতটা যুক্তিযুক্ত আমি জানিনা।”

বাংলাদেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সংগঠন আছে যার নাম ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’। এই সংগঠনটির প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রত্যক্ষ সমর্থন রয়েছে।

এই সংগঠনের সাথে সরাসরি যুক্ত আছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।

তারা বহু বছর ধরে দাবি করছে যাতে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আদিবাসী হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

এই সংগঠনের একজন নেতা রবীন্দ্রনাথ সরেন মনে করেন, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া তাদের জন্য একটি অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়। মি. সরেন নিজে সাঁওতাল গোত্রীয়।

তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই আমি জেনে এসেছি যে আমরা আদিবাসী। আমাদের আশপাশের বাঙালী বন্ধুরা আদিবাসী বলেই জানতো।”

তিনি বলেন তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থা আছে। এ কারণেই নিজেদের আদিবাসী ভাবছেন মি. সরেন।

কিন্তু এ ধরণাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেনা বাঙালীরা। তাদরে যুক্তি: তাদেরও নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য আছে যেটি হাজার বছরের পুরনো। সেজন্য আদিবাসী বিতর্কের কোন সুরাহা করা বেশ কঠিন।

আদিবাসী শব্দটিকে রাজনৈতিকভাবে বেশ স্পর্শকাতর। সরকারের ভেতর অনেকেই মনে করেন দেশের কোন একটি অংশকে আদিবাসী হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দিলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিশেষ করে বাঙালীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বিএনপি আদিবাসী ধারণার সাথে একমত নয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন।

তখন সরকারের দিক থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীগুলোকে যাতে আদিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা না হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেন, আমি যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার ছিলাম, ১৯৬৯-৭০ এমন সময়ে। তখনো কিন্তু সেখানকার চাকমা রাজা ছিলেন এবং আরো দুই রাজা ছিলেন, তখন তাদেরকে আদিবাসী বললে তারা খুব আপত্তি করতেন। এবং বলতেন যে, না আমরা আদিবাসী নই, আমরা উপজাতি। এবং দাবী করতেন তাদেরকে উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক। সেই প্রেক্ষিতে এখন আমি বোঝার চেষ্টা করি নিজে যে,  এমন কী ঘটলো – তারা যারা উপজাতি ছিলেন এখন নিজেদের উপজাতি থেকে আদিবাসী দাবী করছেন?”

মি. ইমাম বলেন, এসব এলাকায় যারা নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করেন তাদের জীবনাচরণ, চাষবাষের পদ্ধতি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড – এসব কিছুই ঐতিহাসিকভাবে ফিলিপাইন এবং কম্বোডিয়ার অঞ্চলের মানুষের সাথে মিল রয়েছে।

তিনি প্রশ্ন তোলেন, “তাহলে তাদেরকে আমরা কিভাবে বলি যে তারা বাংলাদেশের আদিবাসী?”
সরকারের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত সবাই বাংলাদেশর নাগরিক। রাষ্ট্র সবাইকে সমান চোখে দেখবে।

কিন্তু অনগ্রসরমান অংশ হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষজনকে চাকরির ক্ষেত্রে সরকার বাড়তি সুবিধাও দিচ্ছে।

যুক্তি যাই হোক না কেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অনেকেই মনে করেন আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি তাদের প্রাপ্য।

* আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তাদের জীবনে কি কোন পরিবর্তন আসবে?
রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ১৯৭১ সালে বাঙালীদের জন্য জাতি হিসেবে যেমন আত্মপরিচয়ের দরকার ছিল, ঠিক তেমনি বর্তমানে তাদেরও আত্মপরিচয় দরকার।

তিনি বলেন, “বাঙালীরা তো বিশ্বজুড়ে গর্ব করছে। কিন্তু আমরা তো গর্ব বোধ করতে পারছিনা। কারণ সরকার আমাকে স্বীকৃতিটা দিচ্ছেনা।”

বাংলাদেশের কোন একটি জনমানবশূন্য এলাকায় এখন নতুন করে যদি কেউ বসতি গড়ে তোলে তাহলে তাদেরকে সে এলাকার আদিবাসী বলা যায় কিনা – তা নিয়ে প্রশ্ন আছে কোন কোন নৃবিজ্ঞানীর মাঝে।
সরকার মনে করে বাংলাদেশে এক শ্রেণির মানুষ ‘আদিবাসী’ শব্দটির মাধ্যমে বিতর্ক উসকে দিতে চায়।

আদিবাসী বিতর্কের মাঝে একটি বিশ্ব রাজনৈতিক চাল আছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম।

তিনি বলেন, যারা নিজেদের এককালে উপজাতি হিসেবে দাবি করতেন, তারাই এখন বিদেশে গিয়ে নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা চালায়।

– সূত্র: বিবিসি

Exit mobile version