কুতুপালং ক্যাম্পে সংঘঠিত ঘটনায়

কুতুপালং তাবলীগ জামাতের মারকাজে আশ্রয় নিয়েছে ২ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা

fec-image

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একেরপর এক সংঘটিত ঘটনায় ক্যাম্পে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ক্যাম্প জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বন্ধ রয়েছে অধিকাংশ এনজিও অফিস, যান চলাচল এবং দোকান পাট। তবে ফাঁকা সড়কে টহল দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আরসা’র ভয়ে সাধারণ রোহিঙ্গারা কুতুপালং টু-ইস্ট ক্যাম্পের তাবলীগ জামাতের মারকাজে (মসজিদ) আশ্রয় নিয়েছে।

সরজমিন মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বিকেল ৪টায় কুতুপালং, লম্বাশিয়া, মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এমন অবস্থা দেখা যায়।

এসময় লম্বাশিয়া ক্যাম্পের চৌরাস্তার মোড়ে দায়িত্বরত রহমান নামের এপিবিএন (আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন)’র এক উপ-পরিদর্শক বলেন, গত ৫দিন ধরে ক্যাম্পে এধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দিনের বেলায় কিছুটা পরিবেশ ভালো থাকলেও রাতের বেলায় গোলাগুলির শব্দে আতঙ্ক দেখা দেয়।

কুতুপালং টু-ইস্ট ক্যাম্পের বাসিন্দা আহমদ উল্লাহ বলেন, আরসা নেতা মৌলভী হামিদ, খাইরুল আমিন, আবু আহমেদ, মাস্টার এনাম বাহিনীর নির্যাতনের কারণে আমাদেরকে ক্যাম্প ছেড়ে পালানো ছাড়া কোন উপায় নেই। এখন মিয়ানমারেও যেতে পারছিনা, আর ক্যাম্পেও তাদের অত্যাচারে থাকতে পারছিনা। যার কারণে কুতুপালং টু-ইস্ট ক্যাম্পের তাবলীগ জামাতের মারকাজে আশ্রয় নিয়েছি। তার মতে সেখানে প্রায় ২হাজারের অধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।

ওই ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিযোগ করে বলেন, গত ২ দিন পূর্বে আরসা’র নেতা খাইরুল আমিন ও মাস্টার এনামসহ ১০/১২জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ রাতে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে যায়। সোমবার রাতে তারা আবার আমার বাড়ীতে এসে আমাকে নির্যাতনের চেষ্টা চালায়। এই ভয়ে আমি নিজ বাড়ি ছেড়ে তাবলীগ জামাতের মারকাজে আশ্রয় নিয়েছি।

ছৈয়দুল্লাহ নামের আরেক রোহিঙ্গা বলেন, গত ৫ দিনের ঘটনায় ক্যাম্পে ১ নারীসহ ৪ জন খুন হয়েছে। আহত হয়েছে ৪৫ জনের বেশি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু। এ নিয়ে ক্যাম্পে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ ঘটছে দিন দিন অপরাধ প্রবনতা। খুন খারাপির পাশাপাশি ইয়াবা, অস্ত্র, স্বর্ণ এবং ত্রাণের মালামাল ক্রয়-বিক্রয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটছে বলে তার দাবি।

একই ক্যাম্পের মােহামদুল্লাহ বলেন, ক্যাম্প ২ ওয়েস্ট ডি-ব্লকে রোববার রাতে রোহিঙ্গা উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী আসার মৌলভী হামিদ ও আনাসের নেতৃত্বে কয়েকশত সন্ত্রাসী রা দা-লাঠি সোটা নিয়ে এসে ক্যাম্পের অর্ধশতাধিক ঝুপড়ী ঘর ও ৫০টি দোকান ভাংচুর করেছে। প্রায় রোহিঙ্গাদের ঘরে তল্লাশী করে মৃত মৌলভী কাদের বক্সের দুই ছেলে রিদুয়ানশাহ (২০) ও ইয়াছিনশাহকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে যায়। তাদেরকে মঙ্গলবার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

ওই দুই ভাইয়ের চাচা রোহিঙ্গা মাতু জানান, গত সোমবার সকালে ডি-৪ এলাকায় দুইজনকেই জবাই করে খুন করার খবর পেয়ে মৃতদেহ ফেরত চাইলে সন্ত্রাসী মৌলভী হামিদ ৫ লাখ টাকা দাবি করে অন্যথায় লাশ দেবে না বলে জানিয়ে দেয়।

কুতুপালং পুরাতন রেজিস্ট্রার্ড শরণার্থী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ জালাল আহমদ জানান, আরসা গ্রুপ ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে কয়েক’শ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু কুতুপালং ক্যাম্প ছেড়ে অন্য ক্যাম্পে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। বর্তমানে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে দোকানপাট বন্ধ রয়েছে ও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহল দিচ্ছে বলে রোহিঙ্গা নেতারা জানিয়েছেন।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আরসা সন্ত্রাসীদের দাবি বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে তাদের বিরোধী মতাবলম্বীরা কুতুপালং ২-ইস্ট ক্যাম্পের তাবলীগ জামাতের মারকজে আশ্রয় নিয়ে থাকে। আর তাদের নিরাপত্তা দিয়ে থাকে আরসার প্রতিপক্ষ মুন্না গ্রুপ। তাছাড়া আরসার ইয়াবা ক্রয়-বিক্রয়ের গোপন তথ্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট মুন্না গ্রুপের লোকজন দিয়ে থাকে। মূলত রোহিঙ্গা উগ্রপন্থী সংগঠন আরসা ও মুন্না গ্রুপের মধ্যে এসব নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলে আসছে বলে সাধারণ রোহিঙ্গারা জানান। এসব নিয়ে গতি মাসাধিক কালের বেশি সময় ধরে প্রতিরাতে ক্যাম্প গুলোতে শোনা যায় গুলির শব্দ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়জিত ১৪ এপিবিএনের পরিদর্শক ইয়াসিন ফারুক জানান, নতুন এবং পুরাতন রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধের জের ধরে খুনের ঘটনা গুলো ঘটছে।

কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে দায়িত্বরত এপিবিএন (আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন)এর ইন্সপেক্টর সালেহ আহমদ পাঠান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলমান ঘটনায় পৃথক ভাবে ৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় জিয়াউর রহমান (২০) নামের এজাহার নামীয় এক আসামীকে আটক করা হয়েছে। সে কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পের ডি-ব্লকের বাসিন্দা মৃত ইব্রাহিমের ছেলে।

তিনি আরও বলেন ক্যাম্পের যেকোন ধরনের পরিস্থিত এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সার্বক্ষণিক টহল অব্যাহত রেখেছে।

র‌্যাব-১৫ এর কক্সবাজার-ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান জানান, কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় গোলাগুলি ঘটনা ঘটে আসছে। দুদিন আগে র‌্যাব তাদের ধাওয়া দেয়। এক পর্যায়ে তারা কুতুপালং ছেড়ে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চাকমার কুল রোহিঙ্গা শিবির সংলগ্ন পাহাড়ে অবস্থান নেয়। গোপন সূত্রে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালায় র‌্যাব। এসময় আমরা ৯জনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। তাদের কাছ থেকে দেশে তৈরি চারটি অস্ত্র, ২০ রাউন্ড কার্তুজ, কিরিচ উদ্ধার করা হয়েছে।

আটককৃতরা হলেন, রশিদ আহমদ (৩২), ছলিমুল্লাহ (৫৫), শফিক আলম (২০), আব্দুল হামিদ (২০), মো. সাবের (৩২), মো. ছালাম (৫০), ইসমাইল (২৫) হারুনুর রশিদ (২৮) ও ফয়েজ (২২)। আটককৃত সবাই উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।

কুুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে ইনচার্জ (সিআইসি) খলিলুর রহমান খাঁন বলেন, ইয়াবা ব্যবসা ও ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজীর আধিপত্য নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঘটনা গুলো ঘটছে। সাধারণত প্রতি মাসের শেষের দিকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ আহমেদ সঞ্জুর মোরশেদ বলেন, ক্যাম্পের সংঘটিত ঘটনায় ৪টি মামলা হয়েছে। দিনের বেলায় পরিস্থিত ক্যাম্পে স্বাভাবিক থাকলেও রাতের বেলায় ক্যাম্পে কিছুটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তবে সব মিলিয়ে পরিবেশ অনূকুলে রয়েছে৷

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কুতুপালং, জামাতের, তাবলীগ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন