কুশুমছড়ি ক্যাম্প যখন মেঘে ঢেকে যায় তখন মনে হয় কোনো স্বপ্নিল আবহে ডুবে আছি
(২০ )
ফারুয়া ব্যাটালিয়নের শেষ পূর্বের ক্যাম্প ছিলো কুশুমছড়িতে। এই কুশুমছড়ি ক্যাম্পের প্রধান দায়িত্ব ছিলো কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজ তৈরির কাঁচামাল মণ্ড হিসাবে কুশুমছড়ি থেকে দুমদুমিয়াথুমের পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়ী বাঁশ আহরণের পথ সুগম করা নিরাপত্তা প্রদানের মাধ্যমে।
কুশুমছড়ি ক্যাম্প প্রায় সময়ই মেঘে ঢাকা থাকে এবং এই ক্যাম্পে যাবার পথ খুব দুর্গম। কুশুমছড়ি ক্যাম্পে যেতে দু’বার রেঙ্খিয়াংখাল পারতে হয়। এর পরে রাস্তায় দুইবার আকুয়াওয়ালা বাঁশ দিয়ে একবার খাড়া পাহাড়ের উপরে উঠে পথ চলার পরে ক্যাম্পের সামনে খাড়া পাহাড় থেকে পাহাড়ের নীচে ঢালে নামতে হয়। এর পরেই ক্যাম্পের শুরু।
কুশুমছড়ি ক্যামম্পের স্থানটি একটি পাহাড়ের বর্ধিত ঢাল যা শেষের দিকে একটু ওভাল সেপের মতো তবে পরিসর বড় নয়। এখানে ত্রিশ জনের মতো সৈনিক ক্যাম্প করে থাকে বাঁশের চালা ঘরে। কুশুমছড়ি ক্যাম্পের প্রবেশমুখ খুব নেরো। কোনো রকমে চার/ পাঁচ জন সৈনিক একসাথে দাঁড়াতে পারে। উভয় দিকে পাহাড়ের খাদ একশত/ দেড় শত ফুট গভীর। কেউ নীচে পড়ে গেলে তার বাঁচার সম্ভাবনা কম।
কুশুমছড়ি ক্যাম্পে অনেক বড় বড় চাপালিশ গাছের সমারোহ। আমি কুশুমছড়ি ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে দেখলাম চাপালিশ গাছের আরক দিয়ে সৈনিকরা দিয়ারের মতো বাতি জ্বালিয়ে ক্যাম্প আলোকিত করে রেখেছে। কৌতুহল বশতঃ আমি নিজে দেখলাম এই চাপালিশ গাছের আরক আসলে ধুপ। দিয়ার বাতি থেকেও ধুপের সুগন্ধ বের হচ্ছে আনুভব করলাম। এসব দেখে আমার খুব খুশী লাগলো। এটা একটা মজার ব্যাপার বলে আমার কাছে মনে হলো।
কুশুমছড়ি ক্যাম্প একটা অভিনব স্হান বলে সব সময় মনে হয়েছে। দিনের কোনো এক সময় কুশুমছড়ি ক্যাম্প মেঘে ঢাকবেই। পাতলা আস্তরের ধুঁয়ার মতো মেঘ সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। মনে হয় হাত দিয়ে মেঘ ধরি। এ যেন অধরাকে ধরার মতো স্বপ্নিল আনন্দ। মাঝে মধ্যে কুশুমছড়িতে মেঘের স্তর ঘন কুয়াশার মতো যখন হয় তখন ক্যাম্পের বাইরে কিছুই দেখা যায় না। ঐ সময় মনে হয় আমি এক স্বপ্নের দুনিয়ায় বিচরণ করছি। তো এই স্বপ্নের ক্যাম্প কুশুমছড়িতে একদিন আমি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলাম । সেই ভয়াল ঘটনার বিবরণ এখন দিচ্ছি।
তার আগে কুশুমছড়িতে বসে উত্তর-পূর্বে তাকালে কর্ণফুলী পেপার মিলের ( কেপিএম ) বাঁশ বনের অপার সৌন্দর্য নজরে আসবে। মনে হবে সোনালী সবুজের উপরে সূর্যের আলো দিগন্ত জুড়ে যেন এক সোনালী আলোর আভা সৃষ্টি করেছে। তাতে যখন বাতাস ঢেউ খেলে যায় তখন মনে হবে আমি কোন রজত সমুদ্রে অবগাহন করছি। এমন স্হানে মৃত্যু ওঁত পেতে থাকতে পারে ? হ্যাঁ পরে। এমনই ঘটেছিল একদিন।
নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে আমি একটি পেট্রোল নিয়ে প্রথমে শুক্কুরছড়ি আসি। শুক্কুরছড়ি ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে ওখানে লাঞ্চ করে রোদের ঝাঁজ একটু কমলে আমরা কুশুমছড়ির পথে যাত্রা করি। পথে আইক্কাওয়ালা বাঁশ বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠে অনেক পথ হেটে কুশুমছড়ি ক্যাম্পের সামনে এসে আমরা দাঁড়িয়ে দেখি ক্যাম্প মেঘে ঢেকে আছে। আমি প্রথম বাঁশ বেয়ে নীচে নামলাম। নীচে নেমে দেখলাম মেঘের আস্তরে সব হালকা দেখা যাচ্ছে। কুশুমছড়ি ক্যাম্পের সম্মুখভাগ খুব সঙ্কীর্ণ। চার থেকে পাঁচজন সৈনিক ঐ স্থানটাতে দাঁড়াতে পারে। দুইধারে গভীর পাহাড়ী খাদ । নীচে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা নাই।
হঠাৎ আমার সামনে দেখলাম একটি মাঝারি সাইজের হাতি দৌড়ে আসছে আমার দিকে। আমি আমার সাব মেশিন গান কক করে আড়াআড়ি দাঁড়ালাম। কারণ আমি সোজা হয়ে হাতির দিকে তাকালে আমি নিশ্চিত ছিলাম হাতির গায়ে ধাক্কা লেগে আমি নীচে পড়ে যেতাম। তাতে হয়তো জীবন বাঁচলেও ভিষণভাবে আহত হতাম। দেখলাম হাতিটা আমাকে খেয়াল না করে সোজাসুজি পাহাড়ের উপরে উঠে গেল।
হাতির পাহাড়ে উঠার কৌশল দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কেমন যেন দু’পা সামনে দিয়ে অতি সহজেই হাতিটা খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে চলে গেলো। আমার সাথের সৈনিকরা কেবল আল্লাহকে ডাকছিলো আমার জন্য। আমি ক্যাম্পে ঢুকে দেখি সব সৈনিক যে যার হাতিয়ার নিয়ে বাঙ্কারে পজিশনে চলে গেছে। ভাগ্য ভালো যে কেউ হাতিটিকে গুলি করে নাই।
আমাকে দেখে ক্যাম্পের সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলো যে, আমি আহত বা নিহত হই নাই। আমি সেন্ট্রিকে জিজ্ঞেস করলাম হাতিটা কিভাবে ক্যাম্পে ঢুকতে পারলো? সেন্ট্রি জানালো সে হঠাৎ হাতিটাকে দেখে দৌড়ে ক্যাম্পের ভিতরে আসছে। সে চিৎকার দিয়ে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। সবাই নিজের হাতিয়ার নিয়ে পজিশনে চলে যায়। আবার একইভাবে হাতিটা ফিরে দৌড়ে চলে যায়। মেঘের জন্য ক্যাম্পের কেউ আমাকে দেখতে পায় নি।
আমি আজও জানি না হাতিটা জঙ্গলী না পোষা হাতি ছিলো? তবে হাতিটাকে আমার হিট হওয়া হাতি বলে মনে হয়েছিলো। হাতি পোষা কিংবা জঙ্গলী হোক, হিট হলে ভয়ঙ্কর হয়ে যায়। সামনে যাকে পায় পদদলিত করে নয়তো স্যূড় দিয়ে প্যাঁচিয়ে ধরে আছাড় দেয় বা দুরে ছুড়ে ফেলে। হিট হলে হাতির চোখের উপরের স্হান থেকে এক প্রকারের রস বের হয়। ঐসময় দিকবিদিক শূন্য হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে যতক্ষণ না সে পুরুষ কিংবা মাদি হাতির সঙ্গ পাচ্ছে। আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমতে আমি অক্ষত অবস্থায় রক্ষা পাই। বাকী পরে আসছে।
♦ জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমান: প্রাক্তন মহাপরিচালক বিডিআর।