সুখে দুঃখে পেরিয়ে গেল বান্দরবানবাসীর ২০২১ সাল। যদিও বছরের শুরুটা ভালই ছিল। মাঝামাঝি সময়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বেশ কয়েকটি হত্যাকাÐ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিহতের ঘটনা সবাইকে নাড়া দেয়। করোনাকালীন সময়ে বেশ কিছুদিন প্রায় সবকিছু বন্ধ ছিল। ফলে গরিব অসহায় মানুষরা কষ্টে দিনাতিপাত করে। এছাড়া বছরজুড়ে চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার অভিযান। এর ফলে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালটি বান্দরবানবাসীর জন্য ছিল কিছুটা শান্তিুপূর্ণ। তারপরও বিগত বছরটিতে যেসব ঘটনা বান্দরবানবাসীর জন্য আলোচিত ছিল তার মধ্যে আছে বিপুল সংখ্যক মর্টার শেল উদ্ধার, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর ড্রোন ব্যবহার এবং স্থানীয় পর্যটকবাহী গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা।
৪১টি মর্টার শেল উদ্ধার
বান্দরবান সেনা রিজিয়নের অধীনস্থ বলিপাড়া বিজিবি জোনের গ্যালেঙ্গা ইউনিয়ন এলাকায় সোমবার (১৯ জুলাই) জোন কমান্ডারের নেতৃত্বে একটি বিশেষ অভিযানে পরিত্যক্ত অবস্থায় ২৯টি উচ্চ বিস্ফোরক মর্টার শেলের সন্ধান পায়। শেলগুলো উদ্ধার করে পরবর্তীতে ধ্বংস করা হয়। এ ঘটনার একমাস পর রুমায় সেনা অভিযানে পরিত্যক্ত অবস্থায় আরো ১২টি মর্টার শেল উদ্ধার করে রুমা (২৮ বীর) সেনা জোন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সোমবার (২৩ আগস্ট) রাতে মেজর মুহতাদী কামাল আহমদ এবং ক্যাপ্টেন অনিন্দ্য ইমতিয়াজের নেতৃত্বে রুমা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বাচারঢেউ এলাকা থেকে এসব মর্টার শেল উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, পাহাড়ে সক্রিয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অনেক দিন আগেই এসব উচ্চ বিস্ফোরক এনে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল সময় সুযোগ মতো এগুলো দিয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানোর জন্য। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতার কারণে তারা সফল হতে পারেনি।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর ড্রোন
প্রথমবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের আস্তানার খোঁজে ড্রোন ব্যবহার করেছে যৌথবাহিনী। বিগত বছরের ১ ও ২ সেপ্টেম্বর দুই দিনব্যাপী এই অভিযান চালানো হয় নাইক্ষ্যংছড়ির গভীর জঙ্গলে। জানা যায়, বান্দরবান রিজিয়ন অধীনে সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, নারী ও শিশু পাচার রোধ ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন (১১ বিজিবি) শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এরই ধারাবাহিতকতায় দোছড়ি এবং বাইশারী ইউনিয়ন এলাকায় জেএসএস সশস্ত্র দলের সন্ত্রাসীদের আনাগোনা ও দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের নির্মূল করার লক্ষ্যে নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়ন (১১ বিজিবি) ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ হতে ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত একটি বিশেষ অপারেশন পরিচালনা করে। যে অপারেশনে গভীর জঙ্গলে সন্ত্রাসীদের আস্তানা খোঁজে পেতে ড্রোনের ব্যবহার করা হয়েছে। সীমান্ত সংলগ্ন ঘন জঙ্গল বেষ্টিত এলাকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বন্ধ করতে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করে।
পর্যটকবাহী গাড়িতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণ
বান্দরবানে পর্যটকবাহী গাড়িতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণে ২ মারমা মহিলা আহত হন। শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। স্থানীয় সূত্র মতে, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা থেকে রাজস্থলী পোয়াইতি মুখ পাড়া এলাকার সর্বমোট ১৯ জন সাধারণ দর্শনার্থী ভ্রমণ শেষে ফেরত আসার পথে রাঙ্গামাটি-বান্দরবান সড়কের গলাচিপা নামক স্থানে পৌঁছালে একদল উপজাতীয় সন্ত্রাসী তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এতে গাড়িতে থাকা য়ইসিংনু মারমা ও মেহাইসিং মারমা নামক দুই মহিলা আহত হন। পরে আহত দুজনকে চিকিৎসার জন্য চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান হাসপাতলে ভর্তি করা হয়। স্থানীয় সূত্রগুলো গুলিবর্ষণের ঘটনায় জেএসএস মূলের সন্ত্রাসীদের দায়ী করে জানায়, মূলত পর্যটকদের পাহাড়ে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করতেই এ ধরনের ন্যাক্কারজনক হামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম টিকা দেয়া হয়, ১৪ ফেব্রুয়ারি বান্দরবান পৌরসভায় প্রথমবারের মতো ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে চালু হয় প্রথম শিশু পার্ক, ১৪ এপ্রিল বান্দরবান হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্লান্টের উদ্বোধন করা হয়, ১শ বছর পর ৩১ আগস্ট সাঙ্গু রিজার্ভে হেলিকপ্টার দিয়ে ছিটানো হয় গাছের বীজ। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সরকারি ভবন স্থাপন, ব্রিজ ও রাস্তা নির্মাণসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পাদন হয়েছে বান্দরবানে।
স্থানীয়দের মতে, আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালটি বান্দরবানবাসীর অনেকটা ভালো কেটেছে। মানুষের আয়-রোজগারও ছিল মোটামুটি ভালো। তাদের মতে, এ বছরে আঞ্চলিক সংগঠনের গুম, খুনও ছিল তুলনামূলক কম। আইনশৃংখলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কাজী মজিবর রহমান বলেন, পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে পাহাড়ে সেনা ক্যাম্প বৃদ্ধি করে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অব্যাহত রাখতে হবে। ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সাল সবার জন্য আরো সুখময় হবে বলেও তিনি প্রত্যাশা করেন।