কোটি কোটি টাকার অপচয়: রাঙ্গামাটিতে নির্মিত বেইলি ব্রিজে ভারী যান নিয়ে উঠতে ভয় পাচ্ছেন চালকগণ

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি:
রাঙ্গামাটি সড়ক বিভাগ ভেঙ্গেপড়া সড়ক মেরামত কাজে সরকারি কোটি টাকার অপচয় করার অভিযোগ করা হচ্ছে। প্রয়োজন নেই অথচ প্রায় আড়াই কোটি টাকায় নির্মিত বেইলী ব্রীজের উপর ভারী যানবাহন নিয়ে চলাচল করতে ভয় পাচ্ছেন চালকগণ। সড়কের ভাঙ্গনরোধ কল্পে বল্লির খুঁটি (গাছ) নয় প্রয়োজন স্থায়ী সমাধান। ব্রীজ বাদ দিয়ে পাশের সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী, স্থানীয় এবং যানবাহন চালকগণ জানিয়েছে।

গত ১৩ জুন টানা বৃষ্টির পর ও ব্যাপকহারে পাহাড় ধসের সাথে রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়ক এবং শহর এলাকার বেশ কিছু সড়কের পাশ ভেঙ্গে পড়ে। সেদিন শহরের মানিকছড়ি ও ঘাগড়ার মধ্যবর্তী স্থান শালবাগানের প্রায় ৭০ ফুট সড়ক ভেঙ্গে খাদে পড়ে যায়। পরে চট্টগ্রামের সাথে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগ তিন দিনের মাথায় ছোট ও মাঝারি যানবাহন চলাচলের উপযোগী সড়ক তৈরী করলে মানুষের কষ্ট কিছুটা দূর হয়। এসময় জেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী এবং সড়ক বিভাগ একমাসের মধ্যে ভারী যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দেন। পরে দীর্ঘ ৬৯ দিনের মাথায় সড়ক বিভাগ শালবাগানস্থ ভেঙ্গেপড়া সড়কের স্থানে বেইলী ব্রীজ নির্মাণ করে ভারী যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে দেয়।

সাপছড়িস্থ বেইলী ব্রীজের পাশে ছোট ও মাঝারি যানবাহন চলাচলের জন্য সেনা বাহিনী তাৎক্ষণিক যে ব্যবস্থা করেছিল সেটিই এখন যানবাহন চালকদের ভরসা বলে জানা গেছে। বেশ কজন চালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পাহড় ধসে জমাট বাঁধা মাটির উপর সড়ক বিভাগের তৈরী করা বেইলী ব্রীজের তিনটি খুঁটির মধ্যে দুটিই যেন হেলে রয়েছে। ভারী যান নিয়ে ব্রীজ পার হতে ভয়ও লাগে, তাই পাশের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছি। জনৈক ট্রাক চালক জামাল জানিয়েছেন, ব্রীজটি স্থায়ী হবে কিনা সংশয় রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমরাতো গাড়ি চালাই যে কোন ব্রীজে উঠলেই বোঝা যায় এটি কতঠুকু মজবুত। ব্রীজের স্লীপারগুলোসহ অধিকাংশ পুরাতন মালামাল দিয়ে কাজ করা হয়েছে। কোটি টাকার ব্রীজ তেরী করার পরও পাশের সড়ক দিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছে, তাহলে এতটাকা ব্যয় করে ব্রীজের দরকার কেন।

সরেজমিন দেখা যায়, শালবাগানস্থ ভেঙ্গেপড়া সগড়কের পাশে সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগ যৌথ উদ্যোগে পাহাড় ঘেঁষে ছোট ও মাঝারী যানবাহন চলাচলের জন্য মাটি ভরাট করে সড়ক তৈরী করে দিলে যাতায়াত সুবিধা হয়। পরে এ সড়কের পাশেই বেইলী ব্রীজের সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক বিভাগ। অভিযোগ উঠেছে যেখানে মাটি ভরাট করে সড়ক তৈরী করা হয়েছে সেখানে কিছু বাড়তি মাটি ভরাট করলে বেইলী ব্রীজের প্রয়োজন পড়ে না। তাছাড়া সেখানে কোন ছোট-বড় পানি নিস্কাশনের নালা কিংবা ছড়া নেই যে ব্রীজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হবে। অথচ ২ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকায় বেইলী ব্রীজ নির্মাণ করে সরকারি অর্থের অপচয় করা হয়েছে।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী, যানবাহন চালক এবং অভিজ্ঞ মহল বলেছেন, যেখানে কিছু মাটি ভরাট করে ছোট ও মাঝারী যানবাহন চলাচল করছে সেখানে আরো কিছু মাটি ভরাট করলে বড় যানবাহনও চলতো এত টাকা ব্যয় করতে হতো না। বর্তমানে ছোট ও মাঝারী যানবাহন চলাচলের স্থান দিয়েই এখন বড় যানবাহনও চলাচল করছে। এছাড়া ব্রীজ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত অধিকাংশ পার্টস পুরাতন এবং ষ্টীল স্লীপারের গুটিগুলো ক্ষয়ে যাওয়া যা বৃষ্টির দিনে যানবাহন চালকগণ গাড়ির ব্রেক চাপ দিলে দূর্ঘটনার আশংকা রয়েছে।

এছাড়াও সড়ক বিভাগ শহরের বেশ কিছু স্থানে ভেঙ্গে যাওয়া এবং ধসে পড়া সড়ক মেরামত কাজে স্থায়ী কোন সমাধানের চিন্তা না করেই এক যোগে গাছের বল্লি মেরে সড়কের পাশ ভাঙ্গন রোধকল্পে যেভাবে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছে তাতে কোন সমাধান হবে না বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী এবং সরকারি বেসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত কিছু প্রকৌশল বিভাগ এর প্রকৌশলীগণও জানিয়েছেন। দেখা যায়, পুরো জেলা শহরের এমন কোন সড়ক নেই যেখানে কমবেশি ভাঙ্গেনি এবং ধসেপড়েনি। এসব ভেঙ্গে যাওয়া সড়কের ভাঙ্গনরোধ কল্পে একযেগে গাছের বল্লি মারার কাজই চলছে। কিন্তু এসব গাছের বল্লি দিয়ে সড়ক ভাঙ্গনরোধ করাতো যাবেই না বরং বারং বারই সরকারি টাকা অপচয় করা হবে। ভেঙ্গে যাওয়া স্থানগুলোয় দেখা যায়, কোন কোন স্থানে ইটের ধারক দেওয়াল দিয়ে এবং মাটি ভরাট বস্তা ফেলে দিলে সড়কের ভাঙ্গন রোধে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান করা যায়। আবার অনেক স্থানে গাছের বল্লির পরিবতর্তে লম্বা আরসিসি পিলার ব্যবহার করলে সেটি দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং অর্থের অপচয় কমে যাবে।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সড়কের ভাঙ্গন রোধ করতে হলে স্থায়ী সমাধান দরকার। প্রতিবছরই টানা বৃষ্টিতে কোন না কোন স্থানে সড়ক ভেঙ্গে যায় এবং সে সময়ও গাছের বল্লি দিয়ে ভাঙ্গন রোধ করা হয়েছে কিন্তু কয়েক মাস পর সেসব ধারকের কোন অস্তিত্বই থাকে না। কিন্তু এবারের ঘটনা ছিল ভয়াবহ। পাহাড়ী এলাকায় সড়কের ভাঙ্গন রোধে সড়ক বিভাগ গাছের বল্লি মেরে ধারক দেয়াল সৃষ্টি করলেও কয়েক মাস পড়ে সেসব গাছের গোড়া পোকায় খেয়ে ফেললে তখন ধারকের চিহ্নই আর থাকবে না। এভাবে সড়ক ভাঙ্গরোধে প্রতিবছরই অর্থের অপচয় করা হবে তাই প্রয়োজন দীর্ঘ স্থায়ী সমাধান।

এদিকে এ বিষয়ে এলজিইডির এক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, তাৎক্ষণিক বিপদ এড়াতে ভেঙ্গেপড়া সড়কের পাশে গাছের বল্লি দিয়ে ভাঙ্গন রোধ করা যায় তবে সেটি কোন স্থাযী সমাধান নয়। যেহেতু পাহাড়ী এলাকার সড়ক তাই বার বার যাতে ভেঙ্গে না যায় তার জন্য স্থাযী সমাধান দরকার। তাই সেখানে বল্লি না মেরে গাছের সাইজেই স্থায়ী ছোট আরসিসি পিলার দিয়ে কাজ করলে ভাঙ্গনরোধ কিছুটা স্থায়ী হবে এবং অর্থের অপচয় রোধ করা যাবে।

এবিষয়ে সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমদাত হোসেন জানিয়েছেন, অতিরিক্ত বৃষ্টির পর ১৩ জুন পাকৃতিক দুর্যোগে রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ও সড়ক ধসের কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এতে মানুষের সীমাহীন কষ্ট হয়। সাপছড়ির শালবাগানস্থ পাহাড় ধসের সাথে সাথে প্রায় ৭০ ফুট সড়ক ধসে একেবারে নিচে পড়ে যায়। এতে চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও সেনাবাহিনী ও সড়ক বিভাগ যৌথ উদ্যোগে তিন দিনের মধ্যে হালকা যানবাহনের মাধ্যমে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হয়। এতে মানুষের কষ্ট কিছুটা লাঘব হলেও বড় যানবাহন শহরে প্রবেশ করতে পারতো না। টানা দুমাসের কাজ চালিয়ে নির্মিত বেইলী ব্রীজ দিয়ে এখন ভারী যানবাহন চলাচল শুরু করেছে। ফলে শহরের সাথে ভারী যানবাহনের যোগাযোগ এখন উন্মুক্ত হলো।

নির্বাহী প্রকৌশলী আরো জানিয়েছেন, ২ কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বেইলী ব্রীজটি করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গে যাওয়া সড়কের পার্শ্বে গাছের বল্লি দিয়ে মাটি ধারক এর কাজ চলছে। ধীরে ধীরে সড়কের সকল সমস্যা নিরসন হবে। ঘটনার পর ১ মাসের মধ্যে ভারী যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও স্থাপত্য কাজের বিভিন্ন সমস্যার কারণে সেখানে অনিচ্ছাকৃত দুই মাস সময় লেগেছ। কাজ দ্রুত করা হলেও ব্রীজের স্থায়িত্বের জন্য অত্যন্ত মজবুত করা হয়েছে। ভারি যান চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না। এ ধরনের বেইলি ব্রীজ নির্মাণে পিলারে সাধারণত ১শ থেকে ১শ ২০ ফুট অন্তর স্পেস দেওয়া হয়। কিন্তু অধিক নিরাপত্তা ও ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পিলারের স্পেস দেওয়া হয়েছে ৪০ ফুট অন্তর। বেইলি ব্রীজের দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার এবং প্রস্থ ৩ দশমিক ৬৬ মিটার। ভারি যানবাহন চলাচলে ব্রীজের কোনো সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবু অধিক নিরাপত্তার স্বার্থে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই যান চলাচল করতে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন