parbattanews

ক্যাপ্টেন নিজামসহ বিডিআরের ১২ জন শহিদের কথা

ঘটনা ঠিক কী ঘটেছে, আমরা তখনও জানি না। ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র, গুলশাখালী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি। বিডিআরের ৭ রাইফেল ব্যাটালিয়ন তখন গুলশাখালীতে। গুলশাখালীতে বিডিআরের প্রথম ব্যাটালিয়ন এটাই ছিল।

অনেকেই বলাবলি করছে, নওয়াপাড়া ক্যাম্পের কাছে ৭ রাইফেল বিডিআরের একটি দল শান্তিবাহিনীর অ্যাম্বুশের শিকার হয়েছে। অনেকেই মারা গেছে। তাই পুরো এলাকা যেন শোকে পাথর হয়ে আছে। বিডিআর জোয়ানদের মুখে কোনো কথা নেই, চুপচাপ যে যার কাজ করে যাচ্ছে। এলাকার মানুষের মুখেও কোনো কথা নেই।

আমাদের স্কুল মাঠে সাধারণত একটি হেলিকপ্টারকেই মাঝে মধ্যে নামতে দেখে আমরা অভ্যস্থ। কিন্তু সেদিন স্কুল মাঠে নেমেছিল দুটি বিশাল সাইজের হেলিকপ্টার। আরো একটি পাহাড়ের দিকে উড়ে যেতে দেখলাম।

স্কুলে ২/১টি ক্লাস সম্ভবত হয়েছিল, কিন্তু কারো মনোযোগ ছিল না সেখানে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মুখেই শোকের ছায়া। শীতের ঘনকুয়াশা যেন সবকিছুকে ঢেকে দিতে চাইছে। কিন্তু তারপরও শোকের ছাপ ঢাকা পড়ছিল না।

হেলিকপ্টারের ওঠা-নামা আর বড়দের ফিসফাসই যেন ছিল সেদিনের শোনার মতো শব্দ।

পরে আস্তে আস্তে জানতে পারি আরো কিছু ঘটনা। ক্যাপ্টেন নিজাম ছিলেন কুকিছড়া বিডিআর ক্যাম্পে। তিনি একটি বিদেশি কোর্সের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাই সেখান থেকে ফিরে আসছিলেন গুলশাখালীর ব্যাটালিয়ন সদরে। পরে এখান থেকেই যাবেন কোর্সের উদ্দেশ্যে।

কুকিছড়া থেকে বিডিআরের একটি টিম নিয়ে ১৯৯০ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি ফিরে আসছিলেন, অপরদিকে নওয়াপাড়া ক্যাম্প থেকে একটি টিম যাচ্ছিল কুকিছড়ার টিমের কাছ থেকে ক্যাপ্টেন নিজামকে রিসিভ করতে। কিন্তু দুটি টিম একত্রিত হওয়ার আগেই কুকিছড়ার টিমের ওপর শান্তিবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়।

অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রান্ত হয়ে সেদিন ক্যাপ্টেন নিজাম এবং ৭ রাইফেল ব্যাটালিয়নের আরো ১১ জন সদস্য সেখানেই শহিদ হন। নিজেদের ১২ জন সদস্যকে হারিয়ে সেদিন ৭ রাইফেল ব্যাটালিয়নের অন্য সদস্যদের মধ্যে যে শোকের ছায়া দেখেছিলাম সেটা আজো চোখে ভাসে।

তাই ঘটনার যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কারো কাছ থেকে বিস্তারিত জানার আগ্রহ নিয়ে অনেকের কাছেই প্রশ্ন করেছি। খোঁজ-খবর নিয়েছি। কিন্তু তেমন কাউকে পাচ্ছিলাম না দীর্ঘ বছর ধরে। অবশেষে এমন একজনের দেখা পেয়েছি, যিনি সেদিন আহতদের চিকিৎসা দিতে এবং লাশ রেসকিউ করতে গিয়েছিলেন। তিনি হলেন ডাক্তার আব্দুল ওহাব।

ছবি: ডাক্তার আব্দুল ওহাব, সম্প্রতি তিনি পুরনো কর্মস্থল মাইনীমুখ গিয়েছিলেন, সেখানেই তোলা এই ছবি।

 

ডাক্তার ওহাব ৭ রাইফেলে কর্মরত ছিলেন না, তিনি ছিলেন মাইনীমুখ আর্মি জোনের ডাক্তার। কিন্তু সেই সময় বিডিআর মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন জুলফিকর ছুটিতে ছিলেন। সে কারণেই ডাক্তার ওহাবের উপর অর্পিত হয়েছিল এই রেসকিউ অভিযানে যাওয়ার দায়িত্ব।

ডাক্তার ওহাব পরবর্তীতে ২০০৩ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসার নিয়ে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত আছেন। কিন্তু তিনি ব্যারাকের জীবন এখনো ভুলতে পারেন না। বিশেষ করে কুকিছড়ার ক্যাপ্টেন নিজামসহ ১২ জন নিহত হওয়ার কথা তাকে আজো কাদায়, আজো ভাবায়। সেই তাড়না থেকে নিজের স্মৃতি কথা হিসেবে লিখছেন, ‘ব্যারাকে সতের বছর’।

ডাক্তার ওহাবের স্মৃতিকথা হয়তো আমরা অচিরেই মোলাটবদ্ধ বই আকারে পাবো।সেই স্মৃতিকথারই একটি অংশ অপারেশন কুকিছড়া

সেই অপারেশনের ৩২ বছর পূর্তি আজ। জানি না, সেদিন যারা শহিদ হয়েছিলেন তাদের সহকর্মীরা আজো কীভাবে তাদের স্মরণ করেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাই-বা কীভাবে স্মরণ করেন।

তবে এটা জানি, যে গুলশাখালীবাসীর নিরাপত্তা দিতে গিয়ে তারা জীবন দিয়েছিলেন, সেই গুলশাখালীর মানুষের কাছে ঘটনাটি এখনো শোকের, এখনো অনেকের মনে কালো ছায়া বিস্তার করে সেদিনের ঘটনা।

সেদিন যারা জীবন দিয়েছিলেন আমরা তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি, আল্লাহপাক যেন তাদের উত্তম বিনিময় দান করেন।

লেখক:  সাংবাদিক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক

sayedibnrahmat@gmail.com

Exit mobile version