ভূমি খেকোরা নিয়ন্ত্রণহীন

খাগড়াছড়িতে মাটি চাপায় হারাচ্ছে প্রাণ, বর্ষায় পাহাড় ধসে প্রাণহানির শঙ্কা

fec-image

খাগড়াছড়িতে ভূমি খেকোরা যেন নিয়ন্ত্রণহীন। পুরো জেলায় পরিবেশ আইন না মেনে দেদারছে চলছে পাহাড় কাটা,পাহাড় কেটে বাড়ি-ঘর নির্মাণ,পুকুর ভরাট ও ইটভাটার মাটি সংগ্রহসহ বিভিন্ন কাজের অজুহাতে পাহাড় কাটা।একটি সংঘবদ্ধ ভূমি খেকো চক্র পাহাড়ের মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। দিনে-রাতে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কাটার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। তবে সন্ধ্যা নামলে তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটি চাপায় প্রাণ যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অবাধে পাহাড় কাটার কারণে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে জীবনহানির শংকা প্রবল হয়ে উঠছে। কিন্তু থামছে না এই মহোৎসব।

এক শ্রেনীর ভূমি খেকো দেদারছে পাহাড়ের বুকে যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ের জঙ্গল কেটে আগুনে পুড়ে ও পাহাড় কেটে সেখানে গড়ে তুলছে বসতি। প্রশাসনের বক্তব্য অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবো, অথচ খোদ পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করার ৩ সপ্তাহ পরও নিরব প্রশাসন। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে খাগড়াছড়ি প্রাকৃতিক পরিবেশ।

জানা গেছে, গত কয়েক বছরে শুধু খাগড়াছড়ি জেলার রামগড়ে পাহাড় কাটতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে ৩ জনের প্রাণ গেছে। সর্বশেষ শনিবার রাতে (২০ মে) খাগড়াছড়ি রামগড়ে রাতে আধারে পাহাড় কাটার সময় স্কেভেটর উল্টে চালক মো. মিজানুর রহমান নিহত হয়েছেন। এছাড়া ২০১৭ সালে খাগড়াছড়ি পাহাড় ধসে প্রানহাণির পাশাপাশি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় রাকিব হোসেন নামে এক ইট ভাটা মালিকের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন শ্রী মতি রঞ্জন ত্রিপুরা নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু পত্র গ্রহণের প্রায় তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও প্রশাসনের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি।

জানা গেছে, মেসার্স সেলিম এন্ড ব্রাদার্স রাবার প্লান্ট’র ব্যবস্থাপক মতি রঞ্জন ত্রিপুরা দীঘিনালায় রাকিব হোসেন নামে এক ইট ভাটা মালিকের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ । অভিযোগপত্রটি আবেদনটি চলতি মাসের ৩ মে গৃহীত হয়। চিঠি গ্রহণের দীর্ঘ দিন পার হলেও কোন ধরণের তদন্ত বা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি রাকিব হোসেনের বিরুদ্ধে।

গত রমজাম মাসে খাগড়াছড়ি শহরের গঞ্জপাড়া এলাকায় দিনে-রাতে একটি বিশাল আকৃতির পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার করায় প্রতিবেদককে মিথ্যা মামলা ও হামলার হুমকি দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘ দিন ধরে খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন ,ধান্য জমি, পুকুর ও নালা নীরহ মানুষের কাছ কিনে ভরাট করে বেশি দামে বিক্রি করে আসছে। এ ক্ষেত্রে সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিতে কেনা ও বিক্রির ক্ষেত্রে মূল্য কম দেখানো হচ্ছে। এতে চক্রটি লাভবান হলেও সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

অপর দিকে জায়গার মূল্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে হওয়ায় স্থানীয়রা জায়গা ক্রয় করতে পারছেন না। সমতলের লোকজন এসে সে সব জায়গা কিনে নিচ্ছে।

সূত্রটি জানায়, গত কয়েক বছর ধরে চক্রটি খাগড়াছড়ি শহরের জিরোমাইল থেকে শুরু করে জেলা শহরের অধিকাংশ ধান্য জমি,নালা ও পুকুর নিরহ পাহাড়িদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে কিনে নেয়। পরে সে সব জমি মাটি ভরাটের মাধ্যমে উপযুক্ত করে বেশি দামে দামে বিক্রি করছে। জায়গার মূল্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় স্থানীয় সে সব জায়গা কিনতে পারছে না। ভূমি খেকোদের সহযোগিতায় ভূমি চলে যাচ্ছে সমতলের ব্যবসায়ীদের হাতে। গড়ে তুলছে নানা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে কেনা ও বিক্রির প্রকৃত মূল্য গোপন করে সরকারী রাজস্ব ফাঁকি দিচেছ। সে ক্ষেত্রে চক্রটি রাতারাতি ‘ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যাচ্ছে।

এদিকে এক শ্রেনী প্রভাবশালী পাহাড়ের জঙ্গল কেটে আগুনে পুড়ে ফেলছে। কয়েকটি স্কেভেটর দিয়ে কেটে সমান করে বেশি দামে বিক্রি করছে।

এছাড়াও একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘ দিন ধরে পাহাড় ছাড়াও ফসলি জমির টপসয়েল কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইট ভাটায়। ভূমি খেকোরা ইতোমধ্যে খাগড়াছড়ি শহরের অনেক ছড়া-নালা দখল করে নিয়েছে। সেখানে তৈরী করা হয়েছে বিলাস-বহুল ভবন। ফলে ছড়া-খাল সংকোচিত হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে খাগড়াছড়ি শহর পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।

খাগড়াছড়ি পরিবেশবাদী সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মী অপু দত্ত বলেন, অভিযোগ-আন্দোলনত করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। সবুজ পাহাড় এখন আর নেই। নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনি পরিবেশগত প্রভাবও পড়ছে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ার ফলে রাঘব-বোয়ালদের থামানো যাচ্ছে না। বরং সিন্ডিকেটগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠছে। জেল জরিমানার পাশাপাশি সঠিক আইনের প্রয়োগে এখন পাহাড় রক্ষার বড় হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন তিনি।

খাগড়াছড়ি বন বিভাগের উপ-বন সংরক্ষক হুমায়ুন কবীর জানান, যত্রতত্র পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ের ফলে পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ছে। হারিয়ে যা”েছ পাহাড়ের জীব বৈচিত্র্য। নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। এছাড়াও ঝুঁকিও বাড়ছে। পাহাড় ও পাহাড়ের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলছেন তিনি। একইসাথে সামাজিক বনায়ন সৃষ্টির প্রতি নজর দেয়ার জন্য আহবান জানিয়েছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক বলেন, পাহাড় কাটা বন্ধ ও পুকুর-জলাশয় দখল যাতে দখল করতে না পারে তার জন্য নিয়মিত অভিযান চলছে। প্রশাসনের সকল স্তরের কর্মকতাদেরও সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: খাগড়াছড়ি, পাহাড় ধস, ভূমি খেকো
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন