parbattanews

খাগড়াছড়ির রাজনীতি: আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জের মুখে, বিএনপি নির্ভার, ইউপিডিএফের সংসদে প্রতিনিধি পাঠাতে চায়

সরেজমিন খাগড়াছড়ি- ২

খাগড়াছড়ি

অরুণ কর্মকার ও জয়ন্তী দেওয়ান, খাগড়াছড়ি থেকে |
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি থেকে দলের নির্বাচিত প্রতিনিধি জাতীয় সংসদে পাঠানোর লক্ষ্য স্থির করেছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক দলটি সেই লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে বলে দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে।

এদিকে জেলায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আওয়ামী লীগ। একদিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলগুলোর শক্তিশালী অবস্থান, অন্যদিকে নিজ দলে দ্বিধাবিভক্তি। পুনর্বাসিত বাঙালিদের দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলনে জামায়াত ও অন্যান্য উগ্রবাদী শক্তির অংশগ্রহণও দলটির ভাবনার বিষয়।

খাগড়াছড়িতে বিএনপি এখন অনেকটাই নির্ভার। দলে দ্বিধাবিভক্তিও নেই বললেই চলে। আঞ্চলিক দলের চ্যালেঞ্জ থাকলেও কম। জেলায় জাতীয় পার্টি মূলত কিছু নেতাকেন্দ্রিক, গণভিত্তি খুব দুর্বল। আর জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক-সাংগঠনিক কাজ চালাচ্ছে নীরবে-নিভৃতে।

আঞ্চলিক দল
পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে খাগড়াছড়িতে প্রায় একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছে ইউপিডিএফ। রয়েছে জনসংহতি সমিতিও (এম এন লারমা)। তবে প্রত্যন্ত এলাকার ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তারে ইউপিডিএফ অনেক এগিয়ে। তা ছাড়া স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরে এবং বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ দুই দলের মধ্যে সমঝোতা ছিল বলেও জানা যায়।

জনসংহতি সমিতির সূত্র বলেছে, তারা দলের অন্যতম প্রধান মূলনীতি হিসেবে ‘বৃহত্তর জুম্ম ঐক্য’ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করছে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী সমঝোতা হতেই পারে।

জানতে চাইলে জনসংহতি সমিতির অন্যতম শীর্ষ নেতা সুধাসিন্ধু খীসা প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতির বাস্তবতায় একাধিক আঞ্চলিক দল গড়ে উঠলেও নির্বাচন কিংবা আন্দোলন দুই ক্ষেত্রেই সাফল্য আনতে পারে কেবল জুম্ম জাতির ঐক্য।

বিগত সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের প্রার্থী অল্প ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় হন। এরপর ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত গুইমারা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’র জয় জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। অন্যদিকে উৎসাহ বেড়েছে ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীদের।

ইউপিডিএফের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা মুখোমুখি আলাপে প্রথম আলোকে বলেন, মৌলিক দাবিদাওয়াভিত্তিক আন্দোলনের পাশাপাশি তাঁরা নির্বাচনী রাজনীতিও চালিয়ে যাবেন। তাঁরা সংসদে তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধি পাঠাতে চান।

চ্যালেঞ্জের মুখে আওয়ামী লীগ
বিগত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল আলম। তখন থেকে দলের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি প্রকট হতে থাকে।

এরপর খাগড়াছড়ি পৌরসভা নির্বাচনে জাহেদুল দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর (তাঁর ভাই রফিকুল আলম, বর্তমান মেয়র) পক্ষে নির্বাচনে অংশ নেন। এসব কারণে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন।

গত নভেম্বরে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খাগড়াছড়িতে এসে কুজেন্দ্র লাল ও জাহেদুল আলমের হাতে হাত ধরিয়ে মিলিয়ে দিয়ে যান। কিন্তু জেলা কমিটি জাহেদুলকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেনে নেয়নি। জাহেদুলকে বহিষ্কারের পরই জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয় নির্মলেন্দু চৌধুরীকে। এ জন্য নির্মলেন্দু প্রকাশ্যে রাস্তায় শারীরিকভাবে লাঞ্ছনারও শিকার হন।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কারণে বহিষ্কার করার পদক্ষেপ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাহেদুলের দলে ফেরার সম্ভাবনা আছে কি না, জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু লোক সব সময় আওয়ামী লীগকে তাঁদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আবার দলের দুর্দিনে কিংবা প্রয়োজনের সময় সরে গেছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে চলাই আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা এ রকমই। তিনি বলেন, দলে কোনো বিভক্তি আছে বলে তাঁরা মনে করেন না।

তবে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এস এম শফি মনে করেন, দলে বিভক্তি আছে এবং এ কারণে দলের অবস্থা যথেষ্ট নড়বড়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সবার সামনে জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে হাতে হাত ধরিয়ে মিলিয়ে দিয়ে গেছেন। তারপর দলে সিদ্ধান্ত হয়েছে এখন আর কোথাও কাউকে দল থেকে বহিষ্কারের মতো পদক্ষেপ না নেওয়ার। কিন্তু এতেও খাগড়াছড়িতে বিভক্তি ঘোচেনি।

রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরাসহ আরও কয়েকজন জেলা নেতা বলেন, আগে যাঁদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না।

জেলা আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলেছে, নির্বাচনের ময়দানে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান এবং তাঁদের ভোট নেওয়ার কৌশলও আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে ইউপিডিএফের প্রার্থী প্রসিত বিকাশ খীসা আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে অল্প ব্যবধানে হেরেছেন। সেই নির্বাচনে বিএনপি ছিল না। থাকলে ফল অন্য রকমও হতে পারত। ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত গুইমারা উপজেলা নির্বাচনে আঞ্চলিক দলের প্রার্থীর কাছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হেরে গেছেন। এ বিষয়ে রণ বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেন, এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আওয়ামী লীগ তৈরি আছে।

নির্ভার বিএনপি
খাগড়াছড়ির সাবেক সাংসদ ওয়াদুদ ভূঁইয়াকে সভাপতি করে সম্প্রতি বিএনপির জেলা কমিটি পুনর্গঠন করার পর এখানে ‘ঘর গোছানোর কাজ’ শুরু করেছেন দলটির নেতারা। সমীরণ দেওয়ানের নেতৃত্বে দলের যে অংশ জেলা বিএনপির জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হয়ে ছিল, সেটি এখন আর নেই। নতুন জেলা নেতৃত্বকে এই অংশও দৃশ্যত মেনে নিয়েছে। দলীয় সূত্র বলেছে, ওই অংশের কেউ কেউ নতুন কমিটির সঙ্গে ‘ঘর গোছানোর কাজে’ শামিল হয়েছেন।

জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, খাগড়াছড়িতে বিএনপি সুসংহত আছে। বর্তমান অবস্থায় সারা দেশের মধ্যে এখানেই বিএনপি সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে। খাগড়াছড়ির মতো সংগঠন যদি দেশের অর্ধেক জেলায়ও থাকত, তাহলে বিএনপি আন্দোলন করে সরকারকে কাঁপিয়ে দিতে পারত।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন তাঁর অনুপস্থিতির কারণে এখানে অনেক বিষয়ে যে ব্যবধান (গ্যাপ) সৃষ্টি হয়েছে, সেগুলো ঘোচাতে হবে। নেতা-কর্মীদের ওপর থাকা নানা রকম চাপ মোকাবিলার পথ বের করতে হবে। আর আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সেই প্রস্তুতি তাঁরা নিচ্ছেন।

জেলার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতা বলেন, গত কয়েক বছরে জামায়াতের জনসমর্থন বাড়েনি। তবে ভোটের সংখ্যা কমেছে বলে মনে হয় না। পুনর্বাসিত বাঙালিদের দাবি-দাওয়াভিত্তিক আন্দোলনে জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।

সূত্র: প্রথম আলো

Exit mobile version