parbattanews

খাগড়াছড়ির ২ কৃতি ফুটবলার আনাই-আনুচিংয়ের বাড়ি যাওয়ার পথ যেন মরণফাঁদ

বিরল বিজয়ে দেশ ভাসছে আনন্দে। হিমালয় জয় করে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশ ফুটবল নারী দল। দেওয়া হয়েছে “রাজসিক” সংবর্ধনা। বিমান বন্দর থেকে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে বহনকারী ছাদখোলা বাসটি বাফুফে ভবনে পৌঁছেন।পথে পথে জনতার ফুলেল শুভেচ্ছা। এছাড়া কেক কাটা ও দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের গলায় পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ফুলের মালা। সে সাথে চলছে পুরস্কার ঘোষণার মহোৎসবও।প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যক্তি ছুটে যাচ্ছেন অবহেলিত সে সব খেলোয়ারদের বাড়িতে উপহার সামগ্রী ও নগদ অর্থ নিয়ে। অথচ এতদিন এরা ছিল চরম অবহেলিত। যারা বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ পরিচিত দিয়েছে, বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকা উড়িয়েছে তাদের খবর অনেক প্রশাসনের কর্মকর্তা রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। যেমনটি দেখেছি পাশ্ববর্তী জেলা রাঙামাটির দুই কৃতি ফুটবলার ঋতুপর্ণা চাকমা ও রুপনা চাকমার ক্ষেত্রেও। সবাই তাকিয়ে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর দিকে।

এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নের সাথে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের যমজ বোন আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী, জেলার লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার মনিকা চাকমা ও সহকারী কোচ খাগড়াছড়ি সদরের আপার পেরাছড়ার বাসিন্দা তৃষ্ণা চাকমার নামও জড়িয়ে আছে কৃতিত্বের মোড়কে। সারাদেশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন তাঁদের ছবিতে সয়লাব । তাদের জন্য শুভ কামনা অব্যহত রেখেছেন অসংখ্য অনুরাগী।

কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিষয় সেই যমজ বোনের কৃতিত্বে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাতভাইয়াপাড়ায় আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনীদের বাড়ি রাস্তাটি প্রতিশ্রুতির চার বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। তাদের বাড়ি জেলা সদরে হলেও তাঁদের গ্রামটি একেবারেই দুর্গম। পিচঢালার পর ইটের রাস্তা পেরিয়ে সরু-কদমাক্ত পথ মাড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এক সাঁকো পেরোলেই যমজ ফুটবল কন্যা আনাই-আনুচিং মগিনীদের বাড়ি।দুই যমজ কৃতি ফুটবলারের বাবা রিপ্রুচাই মগ আর মা আপ্রুমা মগিনীরা থাকে সেখানে।

যখনই কন্যা আনাই-আনুচিং মগিনীরা দেশের জন্য কোন সু-খবর নিয়ে আসে তখন স্থানীয় শীর্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যান এবং দেন অনেক প্রতিশ্রুতি। কিন্তু সে সব প্রতিশ্রুতি বছরের পর বছর পার হলেও বাস্তবায়ন হয় না।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ্ব-১৫ ফুটবল টুর্নামেন্টে দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি ভারতকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জনের পর ঐ বছরের ৯ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী আনাই-আনুচিং মগিনীদের বাড়ি পরিদর্শনে যান এবং তাদের বাড়ি যাতায়াতের সুবিধার্থে খাগড়াছড়ি ছড়া ব্রিজ নির্মাণ এবং তিন নারী ফুটবলারকে ৫০ হাজার টাকা করে এফ ডিয়ার করে দেওয়াসহ তাদের লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ বহন করা ঘোষণা দেন। কিন্তু ঘোষণার চার বছর পার হয়ে গেলেও সে ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি আজো বাস্তবায়ন হয়নি। তবে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তিন ফুটবলারের বাড়িতে বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।

আনাই-আনুচিংয়ের বড় ভাই মংক্রচাই মগ বলেন, বোনদের গর্বে তাঁরা সব সময় আনন্দে থাকেন। মা-বাবারা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের বাড়ির প্রবেশের পথের রাস্তাটি খুবই খারাপ। আর বর্ষাকালে ছড়ার পানি অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তখন একটি বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাফেরায় ভয় লাগে।

আনাই-আনুচিংয়ের মা-বাবা আপ্রুমা মগিনী ও রিপ্রুচাই মগ বলেন, আমাদের দুই মেয়ে আজ দেশের গর্বে পরিণত হয়েছে। জেলা প্রশাসক আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। কিন্তু আমাদের বাড়িসংলগ্ন খালের ওপর সাঁকোটি ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সেতু নির্মাণের কথা দিয়েছিলেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, কিন্তু কখন হবে আমরা জানি না।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা বলেন, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার মধ্যে শুধুমাত্র আনাই-আনুচিং-এর পরিবারের কিছু অনুদান দেওয়া ছাড়া অন্যগুলো বাস্তবায়ন হয়নি।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আনাই-আনুচিং মগিনী এবং লক্ষ্মীছড়ির মনিকা চাকমার বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শন করেছি।তাদের মা-বাবা, স্বজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যা জেনেছি। সরকারি অর্থায়নে জেলা প্রশাসনের প্রতিশ্রুত মনিকা চাকমার বাড়ি নির্মাণ ও বিদ্যুতায়ন, আনাই-আনুচিংদের বাড়িতে গভীর নলকূপ স্থাপন ও বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। সে সাথে জেলার তিন কৃতি ফুটবলারকে দুই লক্ষ টাকা করে সঞ্চয়পত্র করে দেয়া হয়েছে। এবার সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তিন কৃতি ফুটবলার ও সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমাকেও এক লক্ষ টাকা দেয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তিনি ‘আনাই-আনুচিং’দের বাড়ি যাবার পথে ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকোর পরিবর্তে সেতু নির্মাণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং আক্ষেপ করে বলেন, আমরা সবাই কেন যেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাাকি।

Exit mobile version