parbattanews

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে দলীয় টিকেটে ভাগ্য পরিবর্তনের অপেক্ষায় ওরা এগারো জন

khagrachari

আল-মামুন, খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি :
মেধায় নয়, অর্থই চাকুরী হয়- এ ধরনের প্রথার কারণে ও পরিষদ সম্পূর্ণ দলীয় সিদ্ধান্ত ও দলীয় লোকদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় খাগড়াছড়ি জেলার সাধারন জনগণ অনেক সময় জেলা পরিষদকে ‘জ্বালা পরিষদ’ বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন। সমতল জেলায় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত স্থানীয় এমপি বা তার উর্দ্ধে কারও সাথে যোগাসাজস না থাকলে যেমনি রাজনীতি করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব হয়ে উঠে না, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের যে কোন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বা সদস্য না হলেও ভাগ্য পরিবর্তন করা অসম্ভব।

জেলাবাসী মনে করেন, শুধু জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নয়, জেলা পরিষদ কার্যালয়ের পিয়ন পোস্টে চাকুরী পেলেও ভাগ্য পরিবর্তন সম্ভব, যা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও চাকুরীরতদের চলাফেরা, বাড়ীঘর, অর্থ সম্পদ খতিয়ে দেখলে এর সত্যতা পরিলক্ষিত হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালে তিন পার্বত্য জেলায় (১৯,২০ ও ২১ নং আইন) জাতীয় সংসদে পাশের পর ১ম বারের জন্য তিন পার্বত্য জেলা (স্থানীয় সরকার) পরিষদ নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে আর কোন নির্বাচন হয়নি। ছোট-খাট সংশোধন করা হলেও ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি পরবর্তী ১৯৯৮ সালে উল্লিখিত আইনসমূহ বড়ধরনের সংশোধন করা হয়। সংশোধনের ফলে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে অধিকতর শক্তিশালী করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়।

তবে ১৯৯৭ সালে আইনগত জটিলতার মুখে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন করা সম্ভব না হওয়ার প্রেক্ষিতে “অন্তবর্তীকালীন পরিষদ” গঠনের পদ্ধতি সন্নিবেশ করে আইন সংশোধন করা হয়। উক্ত সংশোধিত আইনে ১৬(ক) ধারা উপধারা-২ অনুযায়ী সরকার একজন চেয়ারম্যান এবং চারজন সদস্য সমন্বয়ে “অন্তবর্তীকালীন পরিষদ” গঠন মর্মে বিধান এনে দলীয় বিবেচনায় নির্বাচিত লোকদেরকে চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। নির্বাচনে নয়, অনির্বাচিত দলীয় বিবেচনায় এভাবেই চলছে দীর্ঘ বছর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ।

সরকারের এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনবিহীন দলীয় লোকদের পদ মর্যাদা দিয়ে ক্রমাগত বসিয়ে দেয়ার নজির দেশের অন্য কোথাও আছে কিনা তাও প্রশ্ন উঠেছে। মেধায় নয়, অর্থই চাকুরী দিতে পারে এ ধরনের প্রথার কারনে ও পরিষদ সম্পূর্ণ দলীয় সিদ্ধান্ত ও দলীয় লোকদের নিয়ে গঠিত হওয়ায় জেলার সাধারন জনগণ অনেক সময় এ প্রতিষ্ঠানকে ‘জ্বালা পরিষদ’ বলেও আখ্যায়িত করেন। যার ফলে প্রতিক্ষণে ক্ষুন্ন হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি। যে সরকার ক্ষমতায় আসে ঐ সরকারই দলীয় লোকদের বসিয়ে দলীয় লোকদের পুনর্বাসন করায় প্রতিষ্ঠানটি রীতিমত দলীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র দলীয় সিলেকশানে পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য বনে যাওয়ার পর অনেক সদস্য সাধারন জনগণতো দূরের বিষয়, নিজ দলের কর্মীদের-ই অবমূল্যায়ন করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্যের বরাদ্দ সহ দেশী-বিদেশী এনজিওদের আশীর্বাদে প্রাপ্ত কোটি কোটি টাকা এক হাতে আসে আরেক হাতে এ পরিষদসমূহ খরচ করলেও কোন জবাবদিহিতা নাই। তন্মধ্যে সরকারের ২৩ টিরও অধিক সরকারী প্রতিষ্ঠানের দায়-দায়িত্বও এ পরিষদের হাতে ন্যস্ত। পার্বত্য চুক্তির ধারা মোতাবেক এ পরিষদ সমূহে বাঙ্গালী সম্প্রদায়ভূক্ত ব্যক্তি চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসতে পারবে না। এছাড়া নারী নেতৃত্ব শূণ্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে। শিক্ষাগত যোগ্যতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, মেধায় নয় শুধুমাত্র দলীয় আশীর্বাদ যার উপর পড়বে সেই হয়ে যাবে এ পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য।

এদিকে, অন্তবর্তীকালীন পরিষদ ৫সদস্য বিশিষ্ট হওয়ায় পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনায় যথেষ্ট নয় বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত মঙ্গলবার নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদ গঠনের গুরুত্ব না দিয়ে মন্ত্রী সভায় পার্বত্য জেলা পরিষদ সমূহের পদ সংখ্যা চেয়ারম্যান সহ-৫ সদস্য থেকে সম্প্রসারণ করে ১১জনের অন্তবর্তীকালীন পরিষদ অনুমোদন লাভের পর খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে দলীয় টিকেট নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কারা হচ্ছে ওরা-১১জন তা দেখার অপেক্ষার প্রহর গুণছে স্থানীয়রা।

অন্তবর্তীকালীন পরিষদ সম্প্রসারনের পর পরই বর্তমান পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যানের মধ্যে টিকে থাকার সংশয় দেখা দিলেও জেলা আওয়ামী পরিবারের চলছে জোরে সোরে লবিং, দৌড়ঝাপ। অনেকে দিনরাত পরিকল্পনা বুনছে কিভাবে হতে পারবে পরিষদের সদস্য ও চেয়ারম্যান। সম্প্রসারিত অন্তবর্তীকালীন পরিষদে ১জন চেয়ারম্যান ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ৭ জন ও বাঙ্গালী জনগোষ্ঠির ৩ জন সদস্য হওয়ার সুযোগ পাবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির ৭ জনের মধ্যে চাকমা ৩-জন, মারমা সম্প্রদায়ের-২-জন এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের দু’জন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। তবে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের কোটায় ত্রিপুরার সংখ্যা চাকমাদের থেকে কম থাকায় জেলায় দীর্ঘদিন ধরে ডমিনেটিং ট্রাইবাল ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।

দলীয় সূত্রে জানায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পদ থেকে ভারপ্রাপ্ত শব্দটি কর্তনে জোর লবিং চালাচ্ছেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চাইথোঅং মারমা। ইদুর দৌড়ে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম ত্রিপুরা, জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও পানছড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা এবং জেলা পরিষদের বর্তমান সদস্য বীর কিশোর চাকমা অটল।

অ-উপজাতীয় কোটায় সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেতে লবিং গ্রুপে যাদের নাম শুনা যাচ্ছে তারা হলেন- মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মো: শামছুল হক, আওয়ামীলীগ সমর্থন নিয়ে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে পরাজিত খাগড়াছড়ি জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক মো: শানে আলম, দীঘিনালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: কাশেম, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো: দিদারুল আলম, মানিকছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এম আবদুল জব্বার, জেলা যুবলীগের সাধারন সম্পাদক কে.এম ইসমাইল হোসেন প্রমূখ।

এছাড়া, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কোটায় সদস্য হিসেবে দলীয় টিকেটের আশা নিয়ে জোর লবিং চালাচ্ছে- সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য ও আওয়ামীলীগ নেতা কংজরী চৌধুরী, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মংক্যচিং চৌধুরী, জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ক্রইসাঞো চৌধুরী, এ্যাড.আশুতোষ চাকমা, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোকনেশ্বর ত্রিপুরা ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল চাকমা ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি,স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত নরোত্তম দাশ বৈষ্ণব সহ একাধিক দলীয় ব্যক্তিবর্গ। তবে শেষমেষ ওরা ১১জন পূর্ণতা কাদের নিয়ে হবে তা এখনও জেলা আওয়ামীলীগ সূত্র যথাযথভাবে জানাতে পারেনি।

উল্লেখ্য, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এ ধরণের বিশেষ অধিকার সম্বলিত ধারাগুলো শান্তিচুক্তির বৈধতা সংক্রান্ত মামলায় উচ্চ আদালতে অবৈধ ও সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষিত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী সরকারের নিকট অবিলম্বে জেলা পরিষদ সমূহে নির্বাচনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান, সদস্য পদে নিয়োগ দেওয়ার দাবী জানিয়ে আসলেও কোন সরকার জনগণের সে আহবানে সাড়া দেয়নি।

Exit mobile version