parbattanews

খেলা, মেলা আর গানে মুখরিত পাহাড়ি জনপদ পানছড়ি

 4 MAY PIC

পানছড়ি প্রতিনিধি:

ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালি সংস্কৃতির সোনালি অতীত। কালচক্রে বিলুপ্ত প্রায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব খেলাধুলা। একযুগ আগেও পাহাড়ি জনপদে নানা ধরনের খেলাধুলার প্রচলন ছিল। কিন্তু আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলোর বেশিরভাগই আজ বিলুপ্তির পথে। পাহাড়ি এ অঞ্চলে এখনও কিছু কিছু খেলা চোখে পড়লেও উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তাও ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা পুনরুদ্ধার, শিশু-কিশোরদের মেধার বিকাশ এবং পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে পানছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শনিবার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রামীণ খেলাধুলার চুড়ান্ত প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন ইউপির প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারীরাই চুড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়।

সকালে উপজেলা পরিষদ মাঠে এ প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুর্শিদুল আলম, উপজেলা মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান রত্না তঞ্চ্যগা, ৫নং উল্টাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত চাকমা, পানছড়ি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা’র সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান কবির সাজু ও যুগ্ন-সম্পাদক নাজির মাহমুদ সহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। দিনব্যাপী আয়োজিত গ্রামীণ খেলাধুলা প্রতিযোগিতার মধ্যে ছিল- হা-ডু-ডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, এক্কাদোক্কা, দড়ি লাফ, বিস্কিট দৌঁড়, সাত চারা, মোরগ লড়াই সহ আরও নানানরকম মনোমুগ্ধকর খেলা। আর সেই সাথে আনন্দের মাত্রা বাড়িয়েছে নাগরদোলা।

মূলত এ সবই ছিল গ্রাম-বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতি। এসব খেলাধুলায় অংশ নেয়ার আনন্দে মাতোয়ারা কিশোর-কিশোরী-যুবক-যুবতীরা ছিল বাঁধভাঙা উল্লাসে। এই সংস্কৃতি চর্চা করেই গ্রামাঞ্চলের শিশুরা তাদের মেধার বিকাশ ঘটাতো, কিন্তু এখন আর তা হয়ে ওঠেনা। একসময় খাগড়াছড়ি জেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে প্রায় শতাধিক গ্রামীণ খেলাধুলার প্রচলন ছিল। এর মধ্যে বাঙালি ছেলে-মেয়েদের হা-ডু-ডু, ডাংগুলি, কাবাডি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ইচিং-বিচিং-চিছিং-ছা, এক্কাদোক্কা, দড়ি লাফ, বালিশ বদল, পুতুল খেলা, রান্নাবাটি, পাঁচগুটি, কড়ি খেলা, চোরপুলিশ, বৌচি, কিতকিত, দৌড়ঝাঁপ, গাদন, চিকে, কপালটোকা, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, মালাম খেলা, কুস্তি, ডুব সাঁতার, নৌকাবাইচ, লাঠিখেলা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, হৈল-বৈল, বস্তাদৌড়, লুকোচুরি এবং পাহাড়িদের পাশা খেলা, আলারী খেলা, বাঁশখরম, নাধেং খেলা, ঘিলা খেলা ও ধ-খেলা সহ হরেকরকম মজার মজার সব খেলা। লাঠিখেলা এবং জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু’র উন্মাদনাও ছিল পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে।

বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং কাশি-বাঁশি বাজিয়ে জাঁকজমকপূর্ণভাবেই আয়োজন করা হতো জাতীয় খেলা হা-ডু-ডু ও লাঠিখেলার। উত্তেজনাপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর এসব প্রতিযোগিতা উপভোগে ঢল নামতো মানুষের, বসতো বিশাল বিশাল মেলা। এসব এখন অতীত মাত্র। এখনকার সময়ের বেশীরভাগ পাহাড়ি-বাঙালি ছেলেমেয়েরাই অধিকাংশ খেলার সাথেই পরিচিত হতে পারেনি। কিছুদিন আগেও রাখালের সুরেলা বাঁশির আওয়াজ ও স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা স্কুলের মাঠ কিংবা পথে প্রান্তরে নানা ধরনের গ্রামীণ খেলাধুলায় মেতে থাকতো। আর বর্তমানে শহরাঞ্চলে তো বটেই প্রত্যন্ত এ পাহাড়ি অঞ্চলেও খোলা জায়গা কিংবা খেলার মাঠের স্বল্পতার কারণে অনেক গ্রামীণ খেলার মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। বর্তমান সময়ে ভিডিও গেইম, টেলিভিশন, মুঠোফোন ইত্যাদি গ্রামীণ খেলাধুলার সে স্থান দখল করে নিয়েছে।

ঐহিত্যবাহী এসব খেলাধুলা বিলুপ্তির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পানছড়ি উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা’র যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক নাজির মাহামুদ জানান, বিজ্ঞানের ক্রমউৎকর্ষতা, উদ্যোক্তা ও পৃষ্ঠপোষকের অভাব, উপযোগী পরিবেশ, পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও খেলাধুলা সামগ্রীর সঙ্কট সহ বহুবিধ সমস্যার ফলে গ্রাম-বাংলার অতীত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ওই করুণদশা। বর্তমান সরকার হারিয়ে যাওয়া গ্রামীন খেলা নিয়ে যে উদ্যেগে গ্রহন করেছে তা বিলুপ্তি হতে চলা খেলাগুলোর প্রাণ ফিরাবে বলে তিনি জানান।

গ্রামীণ খেলাধুলা প্রতিযোগীতা আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে পানছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুর্শিদুল আলম বলেন, ‘পুরনো সেসব খেলাধুলা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এখন তো আর চর্চা করা হয় না। ক্রমান্বয়ে মানুষ হয়ে যাচ্ছে যন্ত্র।’ গ্রাম-বাংলার এসব শিল্প-সংস্কৃতি তরুণ এবং আগামী প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই মনে হবে। বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষা, সোনালি ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার, শিশু-কিশোরদের মেধার বিকাশ এবং পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির লক্ষ্যেই আমরা এই গ্রামীণ খেলাধুলা প্রতিযোগীতার আয়োজন করেছি। এবং প্রতিবছরই এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবেন বলেও জানিয়েছেন তারা।

সকাল নয়টা থেকে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যেগে হারিয়ে যাওয়া গ্রামীন খেলার চুড়ান্ত পর্ব শেষের পর পরই বেলা দুইটায় উদ্বোদন করা হয় ডিজিটাল মেলা। উপজেলা চেয়ারম্যান সর্বোত্তম চাকমা মেলার উদ্বোদন শেষে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মুর্শিদুল ইসলাম ও আগত অতিথিরা সহ মেলার প্রতিটি ষ্টল পরিদর্শন করেন। মেলায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ বিশটি ষ্টল অংশ নেয়। রাত নয়টা থেকে এক মনোজ্ঞ স্বাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খেলা, মেলা ও গানের মত একটি সুন্দর দিনের সমাপ্তি ঘটে।

Exit mobile version