চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ধান

fec-image

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ছোট সোনা মসজিদ ও কোতুয়ালি দরজার মধ্যবর্তী স্থানে ওমরপুরের সন্নিকটে অবস্থিত বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যকীর্তির উল্লেখযোগ্য হলো দারসবাড়ী মাদরাসা, মসজিদ। মহানন্দা নদীর তীর ঘেঁষে তিন কিলোমিটার দূরে বিজিবির সীমান্ত তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে আরো কিছু দূর হেঁটে আমবাগানের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেই দারসবাড়ী মাদরাসা, মসজিদ।

আরবি দরস বা দারস অর্থ পাঠ, উচ্চারণ বিকৃতিতে শব্দটি হয়ে যায় দারাসবাড়ী বা দারসবাড়ী মসজিদ, মাদরাসা। স্বাধীন বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহের রাজত্বকালে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে ১ রমজান সুলতানের আদেশে অখণ্ড বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরের দারসবাড়ীতে একটি সুবিশাল আবাসিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসাটি পাঠক্রম ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় ছিল একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়তুল্য। বাংলাদেশে সন্ধানপ্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন বিশ্ববিদ্যলয় হলো দারসবাড়ী। বিভিন্ন জনপদ থেকে শিক্ষার্থী শিক্ষার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হতেন। এখানেই সর্বপ্রথম সিহাহ সিত্তাহর সমন্বিত পাঠক্রমের সূচনা হয়। এখানেই মুহাম্মদ বিন ইয়াজদান বখশ নামের একজন বুজুর্গ আলেম নিজ হাতে বুখারি শরিফ লিপিবদ্ধ করেন এবং তিনিই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন। যদিও ঢাকার সোনারগাঁয়ে শায়খ শারফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (মৃত ৭০০ হি. ১৩০০ খ্রি.) সর্ব প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হাদিসের আনুষ্ঠানিক পাঠদান শুরু করেন।

দীর্ঘদিন দারসবাড়ীতে মসজিদ, মাদরাসা মাটিচাপা পড়েছিল। ছিল চারপাশ গাছগাছালি ঘেরা, পরিত্যক্ত ভূতুড়ে জনপদ। সত্তরের দশকের প্রথমভাগে খননকাজের মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয় দারসবাড়ী মাদরাসা, মসজিদ। মূলত এলাকাটি ছিল একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় কমপ্লেক্স।

বাংলাদেশে সন্ধান মেলা সর্বপ্রাচীন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দারসবাড়ী শিক্ষা কমপ্লেক্স। সুপ্রাচীন এই ইসলামী স্থাপত্য নিদর্শনটি ছিল বর্গাকৃতির। সব বাহুর দৈর্ঘ ৫১.৫২ মিটার। কমপ্লেক্সের মাঝামাঝি অংশে ৩৭.৫ মিটার পরিমাপের বর্গাকার চত্বরের পশ্চিম বাহু ছাড়া অপর তিন বাহুতে এক সারি করে প্রকোষ্ঠ এবং তিন বাহুর মধ্যবর্তীতে ছিল তিনটি নামাজের জায়গা বা ইমামের কক্ষ। তিনটি কক্ষেই আছে আলাদা তিনটি অবতল মেহরাব। স্থাপনাগুলোর দেয়াল পোড়ামাটির ফলক ও নকশায় অলংকৃত। দারসবাড়ী কমপ্লেক্সে আরো ৩৭টি কক্ষ ছিল। ছিল ওয়াক্তিয়া মসজিদ একটি, অফিস একটি। ছিল তিনটি প্রবেশপথ। বাহ্যিকভাবে দারসবাড়ী ইসলামী কমপ্লেক্স বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কক্ষসংখ্যা ৪০টি হওয়ার কারণে দারসবাড়ীকে ৪০ ঘর বা ৪০ বাড়িও বলা হতো।

দারসবাড়ী মসজিদের কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে থাকলেও ধসে গেছে ছাদ, গম্বুজ প্রভৃতি। নেই নামাজ আদায়ের পরিবেশ; বরং এখন হয়ে গেছে বিষাক্ত সাপের নিরাপদ ঠিকানা। আর প্রাচীন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে কৃষকের কোদালের আঁচড়ে জেগে ওঠা ঐতিহ্যের অতলে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগাথা।

আমরা কি পারি না, পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন চাঁপাইনবাবগঞ্জের দারসবাড়ীর ইসলামী বিশ্বাবদ্যালয়ের মাটিচাপা ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড় করাতে নতুন আরেক দারসবাড়ী মসজিদ, মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি কমপ্লেক্স ও ক্যাম্পাস, অর্থাৎ একটি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়?

তথ্যঋণ : মোহাম্মদ জাকারিয়া, আবুল কালাম, ‘রাজশাহী বিভাগ—ইতিহাস-ঐতিহ্য’। বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস-বরেন্দ্র অঞ্চলের পুরাকীর্তি (প্রথম সংস্করণ) পৃষ্ঠা ৩২০

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান , ইসলামিক স্টাডিজ কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ কাপাসিয়া, গাজীপুর।

সূত্র: কালের কণ্ঠ অনলাইন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন