parbattanews

চৈত্র সংক্রান্তি বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি নয়

‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ – এই শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশে একটি বিশেষ মহল থেকে বাঙালি মুসলিম জনতাকে বিধর্মী অনুষ্ঠানে সম্পৃক্ত করার প্রবল প্রচেষ্টা ও প্রচারণা দেখা যায়। নির্দোষ অনুষ্ঠানে অর্থাৎ যে ধরণের অনুষ্ঠানে যোগ দিলে মুসলমানের তাকওয়া ও আকীদা হানী ঘটে না তা নিয়ে কোনো আপত্তি ওঠার কথা নয়। কিন্তু যেসব অনুষ্ঠান সরাসরি শিরক ও পৌত্তলিকতার উৎস থেকে উৎসারিত, আচার সম্পৃক্ত এমন অনুষ্ঠানে কোনো মুসলিম যোগ দিতে পারে না। কেননা, একগুলো সরাসরি ইসলামী মৌলিক বিধিবিধানের লংঘন। অথচ সার্বজীনন উৎসবের নামে বাঙালি মুসলিম সমাজকে বিশেষত তরুণদের নানা ধরণের পৌত্তলিক বিশ্বাস নির্ভর উৎসবের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। দুর্গোৎসব, রাখী বন্ধন, হোলি উৎসব, ফানুস ওড়ানো, সাকরাইন, হ্যালোইন উৎসব প্রভৃতি বিধর্মী উৎসবে মুসলিম যুবক ও তরুণদের জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। এরকই আরেকটি উৎসব চৈত্র সংক্রান্তি। প্রতিবছর চৈত্র মাসের শেষ দিনে বা বাংলা বছরের শেষ দিন এ উৎসব মহাসমারোহে আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট।

বিগত শতাব্দীর শেষ দশকে ছায়ানটি চেতনার সাংস্কৃতিক কর্মীরা এরও একধাপ এগিয়ে ‘বাঙালী’ সমাজে উৎযাপিত হওয়া ১২ মাসে ১৩ পার্বনকে উৎযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সন্দেহ নেই বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ তাদের ১২ মাসে অনুষ্ঠিত ১৩ পূজাকে ঘিরে ১৩টি পার্বন বা উৎসব পালন করে থাকে। বাঙালী হিন্দুদের এই উৎসবকে ‘বাঙালী সংস্কৃতি’ বলে ব্যাপকভাবে উৎযাপনের ও প্রসারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুসলমানের ঘরে জন্ম গ্রহণকারী ও মুসলমান নাম ধারণকারী কিছু রবীন্দ্রপ্রেমী সংস্কৃতি কর্মী। অথচ এদেশের অধিবাসী ৯০% মুসলমানের যেসব উৎসবে সমগ্র বাংলাদেশ জেগে ওঠে সেই ঈদুল ফেতর, ঈদুল আযহা, মুহররম, ঈদে মিলাদুন্নবী প্রভৃতি উৎসবগুলো উদযাপনে ব্যাপারে তারা থাকে সম্পূর্ণ নির্বিকার।

যাই হোক, এই ১২ মাসে ১৩ পার্বণের অন্যতম হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তি। বাংলা বছরের শেষ দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে বাংলাদেশের এবং ভারতের বেশ কিছু এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা এই চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করে আসছে। উল্লিখিত সাংস্কৃতিক বলয়ের লোকেরা বিগত দেড় দশক ধরে ঘরোয়াভাবে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করে আসছিল এবং তা জাতীয়ভাবে পালনের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ২০০৭ সালে প্রথম তাদের এ প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে। এরপর থেকে বাংলা সনের শেষদিন ৩০ চৈত্র বেশ কিছু জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত সংগঠন প্রকাশ্যে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব পালন করেছে। বেশ কিছু জাতীয় পত্রপত্রিকা চৈত্রসংক্রান্তি নিয়ে বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। বলাবাহুল্য এ সব প্রবন্ধ-নিবন্ধে চৈত্রসংক্রান্তি ও চড়ক পূজাকে ‘সার্বজনীন বাঙালী উৎসব’ বলে তুলে ধরা হয়।

চৈত্র সংক্রান্তি মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব। শাস্ত্র ও লোকাচার মতে, এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি কাজকর্মকে পূণ্যজনক বলে মনে করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবের প্রস্তুতি চলে গোটা মাস জুড়ে। পুরো মাস জুড়ে সন্ন্যাসীরা দল বেঁধে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করে ভিক্ষা মাগে। আর এই ভিক্ষার প্রাপ্ত চাল- ডাল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তির উৎসব আয়োজন করা হয়। গানের দলে শিব হনুমান কালীর মুখোশ পরে থাকে অনেকে। কোথাও কোথাও সন্ন্যাসীরা এ সময় সাথে একটি শিব লিঙ্গ(চড়ক) বহন করে থাকে। সাধারণ সময়ে এই শিব লিঙ্গকে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। ঢোল বাদ্য বাজিয়ে সন্নাসীরা শিব কীর্তন গেয়ে পানি থেকে এই গাছ তুলে আনে। এরপর এই গাছকেও পূজা করা হয়।

চৈত্র সংক্রান্তির মূল উৎসব হচ্ছে চড়ক পূজা। বাংলাপিডিয়া মতে, এটি হিন্দুদের একটি ধর্মানুষ্ঠান। চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে এটি পালিত হয়। এর অপর নাম নীলপূজা। পশ্চিম বঙ্গের গম্ভীরাপূজা বা শিবের গাজন এই চড়ক পূজারই রকমফের। এ পূজা খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিব লিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারীদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। এ পূজার পুরোহিত হলেন আচার্য ব্রা‏হ্মণ বা গ্রহবিপ্র, অর্থাৎ পতিত ব্রা‏হ্মণ। চড়ক ফ’জার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির উপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়ক গাছে দোলা এবং দানো-বারানো বা হাজারা পূজা। দানো- বারানো বা হাজারা পূজা করা হয় সাধারণত শ্মশানে। চড়কপূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পূণর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রাচীন কৌমসমাজে প্রচলিত নরবলির অনুরূপ।

চড়ক উৎসবে বহু প্রকার দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে অর্থাৎ একটি উচুঁ খুঁটিতে ভক্ত বা সন্নাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুত বেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে পায়ে জিহ্বায়এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ ফোঁড়া অর্থাৎ লোহার শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে বিদ্ধ করা হয়। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও গ্রামের সাধারণ লোকের মধ্যে কোথায়ও কোথাও এ অনুষ্ঠান এখনো প্রচলিত আছে।

চড়কপূজা আদি লোক সংস্কৃতির অন্যতম ধারাও বটে। এর উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দুজন সখী। একজনকে সাজানো হয় লম্বা লেজওয়ালা হনুমান। তার মুখে থাকে দাড়ি আর হাতে থাকে কাঠের তরবারী। পুরো দেহ ঢাকা থাকে মাছ ধরার পুরোনো জাল দিয়ে, আর মাথায় থাকে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল।সখীদের পায়ে থাকে ঘুঙুর। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদকদল। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নাচে। এদেরকে নীল পাগলের দলও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় আর নাচ পরিবেশন করে। গ্রামবাসীরা তাদের ইচ্ছামত টাকা-পয়সা ও চাল-ডাল দান করে। কেউবা তাদের একবেলা খাবারও দেয়। এবাবে সারা গ্রাম ঘুরে দলটি দান হিসাবে যে দ্রব্যাদি পায় তা দিয়ে হয় চড়ক পূজা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। সাধারণতঃ তিন থেকে পাঁচদিন পর্যন্ত এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

অন্য একটি সূত্রে বলা হয়েছে, পশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন কাল থেকেই এ পূজার প্রচলন ছিল। লোকশ্রুতি আছে, চৈত্রের শেষ দিন শিবভক্ত বানরাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে শিবকে পাওয়ার জন্য প্রর্থনায় মত্ত হয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত বের করে শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। এতে ভগবান শিব খুশী হন। এ কারণেই শৈব সম্প্রদায়ের মানুষ চৈত্র সংক্রান্তি দিন শিবকে খুশী করতে শরীর থেকে রক্ত ঝরিয়ে চড়ক উৎসবের আয়োজন করে। চড়ক পূজার মূলে রয়েছে ভুত প্রেত ও পূনর্জন্মবাদে বিশ্বাস। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে চড়কপূজার প্রচলন রয়েছে। তবে যে বিষয়টিতে সবার মিল রয়েছে তা হলো: একজন সন্ন্যাসীর পিঠের মাংস পেশীতে লোহার শিক বা বড়শী গেঁথে দেয়া হয়। তারপর মাঠের মাঝখানে খাঁড়া ভাবে পোঁতা চড়ক গাছের(লম্বা শাল অথবা গজারীর গাছ) শীর্ষে মাটির সমান্তরালভাবে স্থাপিত ঘূর্ণণ সক্ষম লম্বা বাঁশ বা কাঠের এক প্রান্তে সন্ন্যাসীর শরীরে গাঁথা লোহার শিকের সাথে বাঁধা দড়ি আটকে ঘুরানো হয়।

“লোকশ্রুতিতে জানা যায়: চড়কের গাছটি হচ্ছে শিবলিঙ্গের প্রতীক। আর সেই গাছের উপর আড়াআাড়িভাবে টানানো বাঁশটি হচ্ছে কালী দেবীর যৌনাঙ্গ। শিবলিঙ্গের উপর ভর করে কালির যৌনাঙ্গের ঘুর্ণন হচ্ছে চড়ক পূজার মর্মকথা। নতুন বছরটা যেন শিব-কালীর যুগল মৈথুনের মতো শস্য উর্বর হয়ে উঠে…” (দৈনিক আমার দেশ, ১১ মে ২০০৭ দ্রষ্টব্য)। “চড়কের মাঠে যাওয়ার আগে বাড়ির উঠানে সন্ন্যাসীদের দেবাংশী বা শিবের অংশ হয়ে উঠার কৃত্যাচারে তাণ্ডব নৃত্য করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে জয় ঢাক বাদ্যের সাথে ভক্তদের হরিবোল উচ্চারণের ভেতর সন্ন্যাসীরা রামদা ও ত্রিশূল নিয়ে বহুবিধ কসরত করে। এরপর সন্ন্যাসীরা চড়ক উপলক্ষে শিবের কাছে মানতকারী গ্রামবাসীদের আনা আমপাতা দিয়ে ঢাকা জলপাত্রের সামনে এসে জয়ঢাক বাদ্যের ভেতর ধূপ ধোঁয়ার ইন্দ্রজাল তৈরী করে মহিষের শিঙ্গা বাজায়। মানতিদের মানত গ্রহণের পর উঠানের একপাশে বিছানো শিতল পাটির দিকে সম্মোহিতের মতো ছুটে যায় শিব-সন্ন্যাসীরা। পাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে তারা তাদের পিঠে চড়কে ঝুলে পড়ার জন্য বড়শি বিঁধিয়ে নেয়।

চড়কের মাঠে উপস্থিত অন্য কিছু ভক্তের গালে ও জিহ্বায় লোহার শিক বিদ্ধ করা হয়। চড়কের মাঠে উপস্থিত কালির মুখোশ পরা জ্যান্ত কালী মূর্তির সামনে জয়ঢাক বাদ্যের সঙ্গে শিবের তাণ্ডব নৃত্য করা হয়। লৌকিক মহাকাব্য রামায়ণের জনপ্রিয় চরিত্র হনুমানজি, রাবণ ও রামের যোদ্ধাদের ভূমিকায় তরুণ ও শিশুদের অভিনয় করতে দেখা যায়। বহুপূর্বে চড়ক পূজার সাথে নরবলীর সম্পর্ক ছিলো বলে কোথাও কোথাও শোনা যায়। তবে কয়েক বছর আগেও সদ্য মৃত মানুষের কাটা মাথা ও তার রক্ত ছাড়া পঞ্চগড় অঞ্চলের চড়ক পূজা হতো না।

চড়ক পূজার আয়োজনের জন্য পুরোহিতের সেবকরা তখন চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে আশে পাশের গ্রামে এবং করবস্থানগুলোতে নজর রাখতো কেউ মারা গেল কিনা? কাউকে কবর দেয়া হলো কিনা? আর চৈত্র সংক্রান্তির ভেতর কেউ মারা গেলে তাকে কবর দিয়ে আসার পর রাতের আঁধারে খুব সতর্কতার সাথে চড়ক পূজার পুরোহিতের সেবকেরা সেই মৃত মানুষের মাথাটা কেটে আনতো। তারপর সেই মাথাকে চড়কের আয়োজনের মধ্যে কালিকে উপহার দেয়া হতো। বর্তমানে ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনগণ বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক হয়ে পড়ার পর এখন আর মানুষের মাথা নিয়ে পঞ্চগড় অঞ্চলে চড়কের আয়োজন হচ্ছে না ঠিকই তবে তার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কবুতর হত্যার রক্ত এবং মৃত মানুষের মাথার খুলি। বর্তমানে একই খুলিকে বারবার চড়কপূজায় ব্যবহার করা হচ্ছে। পূর্বে একেক বছর সদ্য মৃত মানুষের মাথার আলাদা আলাদা মাথা নিয়ে চড়ক পূজা করা হতো।” (পূর্বোক্ত দ্রষ্টব্য)।

এই হলো চৈত্র সংক্রান্তি ও তার মূল উৎসব চড়ক পূজা। উল্লিখিত আলোচনায় নিঃশঙ্কভাবে প্রমাণিত হয়, এটি হিন্দুদের একটি বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। উৎস, ইতিহাস ও পালন পদ্ধতি সবকিছু প্রমাণ করে এটি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তা পালনে মুসলমানদের মনে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না। কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি বা চড়কপূজাকে ‘বাঙালী সংস্কৃতি’ বলে বাংলাদেশী মুসলমানদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এটি সরাসরি শিরকের সাথে জড়িত- ইসলাম ধর্মে যা মহাপাপ। তাই বাঙালি মুসলিম সমাজকে চৈত্র সংক্রান্তির অনুষ্ঠান থেকে সযতনে দুরে থাকতে হবে।

Exit mobile version