ছোট গল্প

পাহাড়ি রশু

fec-image

রশুর সাথে দেখা না হলে বুঝতেই পারতাম না মানুষ এমন হয়। ওর কোন কথাটা হেয়ালি আর কোন কথাটা সত্য সেটা বোঝা যায় না। অনায়াসে সত্যের মতো করে এমন সব কথা বলে যা আসলে বিশ্বাসযোগ্য না, কিন্তু ও যতক্ষণ কথাটা বলে, আপনি বিশ্বাস করতে বাধ্য। আর কথা বলার সময় মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখতে পারে মানুষকে। ওর কথার জাল ছিঁড়ে বের হওয়া যায় না সহজে।

বান্দরবনের নীলগিরি রিসোর্টে যাব। আমি আর আমার স্কুল জীবনের বন্ধু শামীম। সে এখন মেজর, এখানেই পোস্টিং। আমাকে সঙ্গ দিতে দুদিন ছুটি নিয়েছে। চিম্বুক পাহাড়ের রাস্তার কিছুদূর যাবার পর একটা দোকান। সেখানেই দেখা হলো রশুর সাথে। হাতে মিষ্টিকুমড়া, পেপারে মুড়িয়ে মুড়িয়ে চটের বস্তায় ভরছে। হয়তো গাড়িতে করে কারওয়ান বাজারই যাবে এই কুমড়া। অথবা হয়তো অন্য কোনোখানে।

কিন্তু আমরা তখন আর দেখে আলাদা করে চিনত পারব না। পাহাড়ের মেঘগুলো আমাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় আলতো করে। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। এরই মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে মেঘের দল। তেমন তাড়াহুড়ো নেই তাদের। ধীর লয়ে চলছে। এইসব দৃশ্যে ঘোর লেগে যায়। পরিচিত পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো জায়গা মনে হয়। আমার তো স্বপ্নদৃশ্যের মতো লাগে এসব।

রশু কিন্তু মন দিয়ে তার কাজ করে যাচ্ছে। ওকে দেখে বোঝা যায় কাজটাতে সে খুব মজা পাচ্ছে। মনের আনন্দে গান করছে গুনগুন করে। মন দিয়ে শুনলে বোঝা যায় সে ‘লাল পাগাড়ি দেশে যা’ গানটার সুর ভাজছে। আমাদের দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সে গানের মাঝখানে একটু থেমে বলল, ‘জায়গাটা খুব সুন্দর। ছবি তোলেন।’ আবার সে তার গানে আর কাজে ডুবে গেল। আমি হেসে বললাম, ‘আপনি খুব ভাগ্যবান। প্রতিদিন প্রকৃতির এই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করছেন।’

রশু বলল, ‘এই পাহাড়ে কত গল্প আছে! প্রতিটি বাঁকে বাঁকে গল্প।’

একটু আনমনা হলো সে, এই ফাকে গোলগাল ছোটখাট একটা কুমড়া ওর হাত থেকে স্লিপ করল। আমি বললাম, ‘কুমড়া কত করে?’

রশু বলল, ‘কয়টা নিবেন?’

‘বেশি নিয়ে আর কী করব! একটাই নিব।’

‘একটা নিবেন যখন এমনিই নিয়ে যান। দাম দিতে হবে না।’

রশু বাঙালি। চেহারায় স্পষ্ট সেটা। শুনেছি পাহাড়ের মানুষেরা উদার হয়। কিন্তু সে তো পাহাড়ি না। সমতলের মানুষ। তাহলে হয়তো পাহাড়ের মানুষদের সাথে মিশে মিশে উদার হয়ে গেছে মনটা। ওর ব্যবহার খুব ভালো লাগল। ওর হাসি, কথা বলার ভঙ্গি, সবকিছুই কেমন যেন আকর্ষণ করে মানুষকে। দোকানটাতে বসলাম আমরা, শামীম একটা কলা ছিঁড়ে আমার হাতে দিল।

রশুকে বললাম, ‘আপনি একটা খান’। সে বলল, ‘আমি তো রোজই খাই, আপনারা খান তো।’ তারপর খুব সুন্দর করে মিষ্টিকুমড়াটা কাগজে মুড়িয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বসল আমাদের সামনের বেঞ্চিটায়। বলল, ‘দশ বছর আগে এসেছিলাম বান্দরবন। তারপর থেকে এখানেই থেকে গেলাম।’

বলে কী এই ছেলে! আমার খুব অবাক লাগল ওর কথা শুনে। গুল মারছে না তো? কিন্তু ওর চোখমুখ দেখে মনে হলো না মিথ্যে বলছে। গল্পের ঘ্রাণ পেয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পাহাড় আর মেঘের টানে থেকে গেলেন?’

‘নাহ। পাহাড়ি নারীর টানে।’

‘বলেন কী! এ তো মারাত্মক ব্যাপার। কীভাবে কী হলো বলেন তো।’

রশু খুব খুশি হলো বোঝা যায়। সে এই গল্প হয়তো জনে জনে বলতে চায়। সে হয়তো চায় তার ভালোবাসার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক। তারপর সে তার সম্মোহনী গলায় বলতে শুরু করল সেই কাহিনী।

‘একদিন ভোরবেলা আমি রিসোর্টের বাইরে মোটা লোহার তার দিয়ে বেড়া বানাচ্ছি। তিনটা পাহাড়ি মেয়ে ঝুড়িতে করে পেঁপে নিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক আমার বেড়ার কাছাকাছি এসে একজনের পায়ের স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে যায়। বাকি দুজনের চেয়ে সে বেশি সুন্দরী। আমার কাছে এসে একটু তার চায় সে। আমি সুন্দর করে ওর স্যান্ডেলটা মেরামত করে দিই। এভাবে আমাদের পরিচয় হলো। ওর নাম প্রিয়া চাকমা।’

আমরা একটু নড়েচড়ে বসলাম ওর গল্পে। সত্যিই তো সিনেমার মতো ঘটনা। এসব আবার বাস্তবে হয় নাকি। তাছাড়া বাইরে থেকে আমরা শুনেছি পাহাড়িরা একটু কনজারভেটিভ। বাঙালিদের ওরা ভালো চোখে দেখে না। অবশ্য বাইরে থেকে সব জিনিসই একটু অন্যরকম দেখায়। ভেতর থেকে দেখলে পাল্টে যায়। যা হোক, রশু বলতে লাগল।

‘সকালে ঘুম থেকে কোনোদিন উঠতে পারতাম না। শুধু প্রিয়ার জন্য প্রতিদিন ভোরবেলা কাজ শুরু হওয়ার আগে উঠে চলে যেতাম ওই পথের ধারে। যেখান দিয়ে ওরা ভোরের বাজারের উদ্দেশ্য হেঁটে যায়। কিছুদিন পর মনে হতো সেও যেন আমাকে খুঁজত। কিন্তু আমরা তখন কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলিনি। আমরা একসাথে হেঁটে ওকে বাজার পর্যন্ত পৌঁছে দিতাম। প্রিয়াও নানা ছুঁতোয় বান্ধবীদের ছেড়ে একা আসতে লাগল।

এভাবে মাসখানেক পর আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। সকালে প্রিয়াকে না দেখতে পারলে ছটফটানি শুরু হতো। একদিন প্রিয়া আমাকে জানালো তার মায়ের বান্ধবীর ছেলের সাথে তার বিয়ে হচ্ছে আগামীকাল। তখন আমার যে কী হলো! মনে হলো এই সবকিছু বৃথা প্রিয়াকে না পেলে। আমি কোনোকিছু না ভেবে প্রিয়াকে বললাম, আমি তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। তুমি বলো তুমি কী করবে।

প্রিয়ার মুখ দেখে মনে হলো সে যেন এই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সে জানালো যে সে রাজি। আমি আর দেরি করলাম না, সেদিনই ওকে বিয়ে করে ফেললাম। জানার পর প্রিয়ার মা কিছু বলল না। শুধু ওর কাপড়গুলো বস্তায় ভরে ফেলে দিল। আর জানিয়ে দিল ও যেন আর কখনও মায়ের মুখ না দেখতে আসে। আমরা এরপর ওদের এলাকা ছেড়ে এই অঞ্চলে চলে এলাম। ছোট একটা ঘর বানিয়ে আমি আর প্রিয়া থাকি। আমাদের কোনো কষ্ট নেই। প্রতিদিন এরকম মেঘের সারি আমাদের ভালোবাসার চিঠিগুলো নিয়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যায়। আমরা পাহাড়ে নানারকম ফল আর সবজি ফলাই। দূরের দেশে চলে যায় আমাদের ভালোবাসার চাষাবাদের ফল আর সবজি। এজন্য আজকে আপনাকে কুমড়াটা এমনিই দিলাম। ভালোবাসার উপহার।’

রশুর আরও গল্প ছিল কিন্তু আমাদের সময় নেই। উঠতেই হলো। রশুকে বললাম এরপর সময় নিয়ে এসে ওর প্রিয়াকে দেখে যাব। পারলে তার হাতের এক কাপ চা খেয়ে যাব। রশু হাত দিয়ে ওদের ঘরটা দেখালো, সত্যি সেখানে তখন একটা শুভ্র মেঘখণ্ড ছুঁয়ে আছে আলগোছে।

লেখক: রাহিতুল ইসলাম, সাংবাদিক ও লেখক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন