জঙ্গি প্রতিরোধে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভিযান

নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি:

মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) দেশের পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি দূর্গম পাইনছড়ি, কুলাচি, লেমুছড়ি, বাকখালী, টেংরাটিলা, কুরিক্ষ্য, বেতেরঝিরি এলাকার জিরো পয়েন্ট এলাকায় জঙ্গি অপতৎপতায় লিপ্ত আরএসও,আরএনও জঙ্গি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বলে স্থানীয় ও বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে ।

মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)’র মগ এরিয়া ০১-১৫ সার্ব ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার কর্ণেল টিডাডিং এর নেতৃত্বে বাংলাদেশেরে পার্বত্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুছড়ি ইউনিয়নের দূর্গম পাইনছড়ি, কুলাচি, লেমুছড়ি, বাকখালী, টেংরাটিলা, কুরিক্ষ্য, বেতেরঝিরি, লংঘদু এলাকার বিপরীতে ৫২-৫৫ সীমান্ত পিলার এলাকায় অবস্থানরত মায়ানমার বিদ্রোহী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনালিস্ট অর্গানাইজেশনের (এআরএনও) জঙ্গি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে ।

ওই অভিযান ৭ আগষ্ট থেকে ১২ আগষ্ট পর্যন্ত চলবে বলে গোয়েন্দা সংস্থা, বিজিবি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় জনসাধারন সূত্রে জানা গেছে । এছাড়া গত ৯ আগষ্ট ভোর রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দুছড়ি ইউনিয়নের বাকঁখালীর লংগদুর বেতের ঝিরির কবির আহমদ এর খামার বাড়ীতে ১৮-২০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ অবস্থান করে । মুখোশ পরিহিত ওই সশস্ত্র গ্রুপের চলাচলে এলাকাবাসী ভয়ে দরজা বন্ধ করে পেলে । প্রায় দীর্ঘ ৪ ঘন্টা পর ওই সশস্ত্র গ্রুপ এলাকা ছেড়ে চলে যায় । চলে যাওয়ার সময় প্রায় ৭ রাউন্ড গুলি ছুটেঁ বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা কবির আহমদ ও জালাল আহমদ । তারা দুইজনেই বলেন-আমরা অস্ত্র নিয়ে ১৮-২০ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ বেতেরঝিরির কবির এর খামার বাড়ীতে আসার খবর পান । খবর পেয়ে দুর থেকে তাদের কে চেনার চেষ্টা করেন । তারা জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সদস্য হতে পারে বলে তাদের ধারণা ।

স্থানীয় মহিলা ইউপি সদস্যা রেহেনা বেগম বেগম বলেন-ভোর ৫ টার দিকে লোকে মূখে শুনতে পায় আরএসও আমার ওয়ার্ডের দক্ষিণে বেতেরঝিরি এলাকার কবির আহমদের খামার বাড়ীতে অবস্থান করছে । এরপর প্রায় ৭-৮ রাউন্ড মত গুলির শব্দ শুনি । এর আগে তারা ৪-৫টি বাড়ীতে প্রবেশ করে এলোপাথাড়ি তল্লাশি করে বিভিন্ন জিনিসপত্রের ক্ষয়ক্ষতি করে । সকাল ৬ টার দিকে বেতের ঝিরির হয়ে লংগদুর দিকে চলে যায় । এর পর ওই এলাকায় আতংক বিরাজ করছে ।

এছাড়া গত ১০ আগষ্ট সকাল ১১ টার দিকে ৪৩ সীমান্ত পিলার হয়ে প্রায় ২০-২৫ রাউন্ড গুলি বর্ষনের পর একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ জিরো পয়েন্ট থেকে ৫০ নং সীমান্ত পিলার এলাকার দিকে চলে যায় বলে জানান ফুলতলীর ইউপি সদস্য আবুল হোসেন ও প্রত্যক্ষদর্শী আশারতলীর জয়নালের পুত্র শামসুল আলম (৩৬) ।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার সীমান্ত উপজেলা গুলিতে মায়ানমারের বিদ্রোহী জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) সংগঠিত হয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে । আরএসও’র অপতৎপতা সরকারের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে । আরএসও’র সংগঠিত হওয়ার জন্য দেশে-বিদেশে কয়েক দফা বৈঠকও বসে ।

উল্লেখ্য, দেশের পার্বত্য নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তে এই আরএসও’র সাথে মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)’র সাথে দফায় দফায় গুলি বিনিময় হয় । উক্ত গুলিবর্ষণের ঘটনায় মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপির কয়েকজন সীমান্ত রক্ষী নিহত হয় । এর রেশ ধরে নাইক্ষ্যংছড়ি পাইনছড়ি সীমান্তে টহলকালে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের নায়েক মিজানুর রহমানকে অপহরণ করে নিয়ে যায় । দুই দিন পর তার মৃত দেহ বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বিজিবি’র কাছে ফেরত দেয় ।

উক্ত ঘটনা সমাধান ও কেন বিজিবি সদস্যকে গুলি করা হয়েছে এসব বিষয় নিয়ে দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় মায়ানমার সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে উদ্যোগ নেয় । এর পর এক সপ্তাহের মাথায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী মায়ানমার মংন্ডু শহরে উচ্চ পর্যায়ে পতকা বৈঠকে বসে । ওই বৈঠকে মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী অভিযোগে জানায়,বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন (বিজিবি) সীমান্তে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় প্রদান করেছে এবং তারা সর্ব প্রথম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে । ওই সময় মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তের বিভিন্ন উপজেলায় বর্তমানে যেসব আরএসও’র নেতা সক্রিয় এবং অপতৎপরতায় লিপ্ত তাদের একটি তালিকা বাংলাদেশ সরকারকে প্রদান করে । ওই তালিকায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ২২ জন, আলীকদমের ২০ জন, লামার ১৫ জন, উখিয়ার ২০ জন ,টেকনাফের ২জনসহ প্রায় তিন শতাধিক ব্যক্তির নাম জমা দেয় ।

ওই দিন মায়ানমার সীমান্তরক্ষী অভিযোগে জানায়, বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্তে আরএসও ইয়াবা, মাদক, চোরাচালান, চাদাঁবাজি, অপহরণসহ প্রভৃতি অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে । এ সময় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন সীমান্তে আরএসওকে প্রশ্রয়দানের বিষয়টি অস্বীকার করে । এরপর বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা-জঙ্গিরা সেনাবাহিনীর পোশাকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ, অপতৎপতার করছে কি না- তা তদন্ত করে দেখতে সব কটি গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে এ নির্দেশ পাঠানো হয় এনএসআই, ডিজিএফআই, পুলিশ, বিজিবি, এসবির কাছে। তদন্তের পর এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জরুরী ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়কে জানাতে বলা হয়েছে।

এরপর ওইসব গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে সঠিক তথ্য উপস্থাপনের জন্য কক্সবাজার ও পার্বত্য বান্দরবান সীমান্তে চষে বেড়িয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোথাও আরএসও’র আস্তানা বা অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। সীমান্তের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ’র (বিজিপি) মধ্যে সেক্টর কমান্ডার পর্যায়ের পতাকা বৈঠকে সীমান্তে দু’দফা গুলিবর্ষণ এবং এর ফলে বিজিবি’র সদস্য নিহতের ঘটনায় মিয়ানমার দুঃখ প্রকাশ করেছে।

গত ৫ জানুয়ারী মিয়ানমারের মংডু টাউনশীপে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সম্প্রতি নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি সীমান্তের জিরো পয়েন্টে বিজিপি’র গুলিবর্ষণে নিহত বিজিবি’র নায়েক মিজানুর রহমানের লুট হওয়া ১টি এসএমজি, ৪টি ম্যাগজিন ও ১২০ রাউন্ড গোলাবারুদ ফেরত দেয়।

ওই দিন বিজিবি’র কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল খোন্দকার ফরিদ হাসান পতাকা বৈঠক শেষে মিয়ানমারের মংডু থেকে বাংলাদেশে ফিরে টেকনাফ স্থলবন্দর জেটিতে অপেক্ষামান সাংবাদিকদের ‘বৈঠক ফলপ্রসু ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে’ জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল ১৯৪৭ সালের জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক সীমান্তের জিরো পয়েন্টে সেনা মোতায়েন নিষিদ্ধ থাকলেও মিয়ানমার কেন তা বারবার করে যাচ্ছে?

মিয়ানমার বাহিনী বিজিপি কেনই বা ২৮ মে বিনা কারণে ৫২ পিলারের অদূরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টহল দেয়া বিজিবি সদস্যের ওপর গুলিবর্ষণ করে- যাতে নায়েক মিজান মারা যান, ৩০ মে গুলিতে নিহত নায়েকের লাশ ফেরত দেয়ার কথা থাকলেও তা না করে লাশ গ্রহণকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ- এমনকি মর্টার শেলের মতো অস্ত্রের ব্যবহার করা, সীমান্তে চোরাচালান-ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য পাচার রোধ ও উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে কর্মকৌশল প্রণয়ন বিষয়ে ৫টি এজেন্ডা মিয়ানমারের সঙ্গে ফলপ্রসু আলোচনা হয়।

বৈঠকে মিয়ানমার পক্ষ ‘ভবিষ্যতে আর জেনেভা কনভেশন লংঘন হবে না’ নিশ্চয়তা দিয়ে ‘রোহিঙ্গা জঙ্গি সংগঠন আরএসও’র সস্বস্ত্র অপতৎপরতা রোধ করতে গিয়ে ২৮ মে ও ৩০ মে সীমান্তে গুলিবর্ষণের মত দুঃখজনক ঘটনা ঘটে’ বলে তাদের ভুল স্বীকার করে। এতে ‘বিজিবি’র একজন সদস্য নিহত ও দু’দফা গুলিবর্ষনের জন্য’ মিয়ানমার আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে নিহত বিজিবি সদস্যের লুট হওয়া ১টি এসএমজি, ৪টি ম্যাগজিন ও ১২০ রাউন্ড গোলাবারুদ বিজিবি’র কাছে হস্তান্তর করে।

এছাড়া দু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ইউনিফরমের স্বচ্ছ্বতা বজায় রাখা, যৌথভাবে সীমান্ত পিলার চেকিং ও সমন্বিত টহল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং জঙ্গি প্রতিরোধে মায়ানমার ও বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী যৌথ ভাবে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয় । ওই সিদ্ধান্তের আলোকে মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপি সীমান্তে অভিযান চালাচ্ছে বলে জানা গেছে । ওই দিন দু’দেশের অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে বিজিবি’র কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল খোন্দকার ফরিদ হাসান । এবং মিয়ানমারের পক্ষে সেদেশের মংডুস্থ ইমিগ্রেশন হেড কোয়ার্টাসের ডাইরেক্টর ব্রিগেডিয়ার থিং কু কু’র নেতৃত্বে ১৫সদস্যেরপ্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন