জাতিসংঘ দূতের আহ্বান মিয়ানমারকে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্তের 

fec-image

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে তদন্ত শুরুর আহ্বান জানিয়েছেন। আল জাজিরার তথ্যমতে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন ও চিন অঙ্গরাজ্যে বর্মি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নতুন অভিযোগ উঠার পর এই আহ্বান জানান জাতিসংঘের স্পেশাল র‍্যাপোর্টেয়ার ইয়াংহি লি।

আল জাজিরার খবরে বলা হয়, বুধবার ইয়াংহি লি অভিযোগ করেন, বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানালেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তা অগ্রাহ্য করে ওই দুই পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যে সশস্ত্র আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর ভয়াবহ দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী পদ্ধতিগতভাবে আন্তর্জাতিক মানবিকতা বিষয়ক আইন ও মানবাধিকারের একেবারে মৌলিক নীতিগুলো লঙ্ঘণ করছে। রাখাইন ও চিন অঙ্গরাজ্যে বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর আক্রমণ যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য হতে পারে।”

খবরে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সদস্যদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘাত বৃদ্ধি পেয়েছে। সামরিক বাহিনী এই রাখাইন জাতিগত বিদ্রোহী বাহিনীটিকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মিয়ানমার যখন করোনাভাইরাস জনিত জরুরী অবস্থার মুখোমুখি, ঠিক তখনই দেশের এক অংশে সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে।

কভিড-১৯ রোগ সংক্রমণের ঘটনায় আরাকান আর্মি সহ আরও দু’টি জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এপ্রিল মাসে অস্ত্রবিরতি ঘোষণা করেছিল।

তবে সেনাবাহিনী সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে এই যুক্তিতে যে, সরকার ঘোষিত পূর্বের অস্ত্রবিরতি এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী মানেনি। সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ১ লাখ ৫৭ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। নারী ও শিশু সহ শ’ শ’ মানুষ নিহত হয়েছে।

এই রাখাইন অঙ্গরাজ্যেই ২০১৭ সালে পৃথক এক সহিংসতা হয়েছিল। লাখ লাখ রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু ছিল ওই সহিংসতার লক্ষ্য। জাতিসংঘের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা একে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।

ইয়াংহি লি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাখাইন ও চিন অঙ্গরাজ্যের সাম্প্রতিক এই সহিংসতায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী বেসামরিক অঞ্চলে বিমান ও বোমা হামলা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব হামলায় বহু শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিহত হয়েছে।

আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সন্দেহে অনেককে বহুদিন ধরে আটক রাখা হচ্ছে ও নির্যাতন করা হচ্ছে। স্কুল, ঘরবাড়ি ও একটি বৌদ্ধ মন্দিরও পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। ৭০০ বাড়িঘড় সমেত গোটা একটি গ্রামই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

ইয়াংহি লি বলেন, “১৩ই এপ্রিল সেনাবাহিনীর এক কামান হামলায় পনাগ্যুন শহরের ক্যায়ুক সেইক গ্রামে ২ শিশু সহ ৮ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন।” প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে বলেছেন যে, ওই হামলার পর পুরো গ্রামের সমস্ত মানুষজন পালিয়ে গেছেন। এছাড়া কয়েক ডজন পুরুষকে গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যাও করেছে সেনাবাহিনী।

২২শে মার্চ ক্যকত এলাকার তিন মা গ্রামে প্রায় ৭০০টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার পর, অন্তত ১০ জন পুরুষকে গুম করা হয়। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একজনের লাশ পাওয়া যায়। অনেকের ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষও পার্শ্ববর্তি নদীতে পাওয়া যায়।
চিন অঙ্গরাজ্যে হাজার হাজার মানুষের জন্য ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে রেখেছে সামরিক বাহিনী। সেটির বিস্তারিতও ইয়াংহি লির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এছাড়া মানুষ জরুরী স্বাস্থ্য সহায়তাও নিতে পারছে না বলে জানানো হয়। গুরুতরভাবে আহত এক কিশোরকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সেনা চেকপয়েন্টে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। পরে ওই কিশোর মারা যায়।

লি বলেছেন, সংঘাত বন্ধে জবাবদিহিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বাহিনী দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনীর কৌশল মানুষের সর্বোচ্চ মাত্রার দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। আমরা সবাই জানি যে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের প্রতি তারা কী করেছিল। তারা এখন সংঘাত উপদ্রুত অঞ্চলের বেসামরিক মানুষকে টার্গেট করছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাখাইন, রোহিঙ্গা, ম্রো, দেইগনেত ও চিন সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অপরাধের অভিযোগ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তদন্ত করতে হবে। দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।”

প্রতিবেদনে বিদ্রোহী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধেও যুদ্ধবিগ্রহের অভিযোগ আনা হয়। তিনি বলেন, এর ফলে বেসামরিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। অভিযোগ করা হয়, স্থানীয় বেসামরিক কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যদের পর্যন্ত অপহরণ করেছে এই সংগঠন।

লি আরো বলেন, এই মুহূর্তে মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনী‘সহ সকল কর্তৃপক্ষের উচিৎ কভিড-১৯ সংকট মোকাবিলা করা। অথচ, এই সংঘাত চলাকালে ত্রাণকর্মীদেরও আক্রমণ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গাড়ি চালক এবং স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের এক কর্মী আহত হন। পরে ওই গাড়ি চালক মারা যায়। সিতওয়ে থেকে ইয়াঙ্গুনের দিকে করোনাভাইরাসের টেস্টিং স্যাম্পল পরিবহণের সময় জাতিসংঘের লোগো সম্বলিত গাড়িতে গুলি করা হলে ওই চালক আহত হন।

লি বলেন, “মানবিক সাহায্যকর্মীরা লক্ষ্যবস্তু নয়! তাদেরকে আক্রমণ করা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘণ। কে এই আক্রমণের জন্য দায়ী, তা নিয়ে অবশ্যই তদন্ত হতে হবে। দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।”

ছয় বছর দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যাওয়ার প্রাক্বালে মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের এই দূত দেশটির সরকার ও সামরিক বাহিনীকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের পদক্ষেপ ও গণহত্যা কনভেনশন মেনে চলতে দেশের প্রেসিডেন্টের দেওয়া নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জাতিসংঘ, মিয়ানমার, সেনাবাহিনী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন