parbattanews

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শীর্ষক সেমিনারে প্রবল হট্টগোল

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের মূল যে আশা-আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে এই জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, লড়েছিল, সেটি থেকে বিচ্যুত হয়ে একটি ভ্রষ্ট পথে নষ্ট রাজনীতির সূচনা হয়েছে এ দেশে। সেটি চলতে চলতে আজকে এই পরিণতিতে এনে গোটা দেশকে দাঁড় করিয়েছে।

আজ শুক্রবার ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর এক আলোচনা সভায় বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এসব কথা বলেন। আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল।

খালেকুজ্জামান বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে সংঘাত হলো। পরে চুক্তি হলো। তখনই বলা হয়েছিল, এই চুক্তিটি একটি সান্ত্বনা চুক্তি। ওরা পার্বত্য চুক্তিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তি বলে। আসলে এটা শান্তি চুক্তি না, এটা পার্বত্য চুক্তি। তিনি বলেন, যখনই একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা চালু হয়, শোষক শ্রেণির দায়িত্ব হয় শোষিত শ্রেণিকে বিভক্ত করা। তাদের শোষণ আর বিভাজনের কারণে যে বৈষম্য তৈরি হয়, সেটার বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। একটি বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আরেকটি জনগোষ্ঠীর ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করা হয় এবং তাদের বিভক্ত করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান আরও বলেন, পাহাড়ি পাহাড়ি বলে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয়। তারা বাংলাদেশের নাগরিক। যেমন একটি ধোয়া তোলা হলো, পাহাড়িরা আলাদা হয়ে যেতে চায়। এমন একটি ভুয়া কথা বলে সেখানে সামরিক শক্তিতে দমন করতে হবে এবং এদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে ফেলতে হবে। এসব চক্রান্ত শাসক গোষ্ঠী করে। সেখানে পাহাড়ি, বাঙালি, দরিদ্র জনগোষ্ঠী ৯৫ শতাংশ মানুষই নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার।

জাতীয় গণফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতা রজত হুদা বলেন, চট্টগ্রামে যে শোষণ, লুণ্ঠনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা সারা দেশে বিরাজ করছে। তিনি বলেন, পাহাড়ে ও সমতলে মানুষকে বাঁচাতে হলে প্রগতিশীল লোকদের সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে মিটিং, মিছিল, সমাবেশের অধিকার নেই। সমতলে গণতন্ত্রের অধিকার আদায়ের আন্দোলন যেভাবে বাধা দেওয়া হয়, তার চেয়েও বেশি বাধা দেওয়া হয় পাহাড়ে। তিনি অভিযোগ করেন, পাহাড়ে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। কারা তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছে? নির্বাচনী কর্মকর্তাদের হত্যায় কারা জড়িত? অথচ সাধারণ জনগণকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

আলোচনা সভায় কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সদস্য সুপ্রিতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশ একটি কারাগারে পরিণত হয়েছে। বিনা মামলা, পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সমতলে যেভাবে ক্রসফায়ার চলছে, পাহাড়ে অন্যরূপে ক্রসফায়ার চলছে। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজনৈতিক হত্যা চলছে। প্রতিরোধ ছাড়া তাঁদের কোনো বিকল্প নেই।

পিসিপির সাধারণ সম্পাদক সুনয়ন চাকমা বলেন, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক সৃষ্টি করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে খুনের রাজনীতি শুরু হয়েছে। সেখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। জ্ঞান শঙ্কর চাকমার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে।

বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রির সভাপতি ইকবাল কবির বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নামের একটি সেটেলার জনগোষ্ঠীকে অন্যান্য জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের নেতা নাসির উদ্দীন হেলাল বলেন, ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩৫৪৩জনকে ক্রসফায়ার দেয়া হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫১৯জন গুম হয়েছে। যেভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কল্পনা চাকমা গুম হয়েছে।

বাংলাদেশ লেখক ফোরামের সভাপতি কমরেড হাসিবুর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি থেকে উচ্ছেদ চলছে। তবু সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদটা রয়েছে তাই আমরা তাদের পক্ষে কথা বলি।

আলোচনা সভা চলার সময় পার্বত্য অধিকার ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি পরিচয় দিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে আগত মো. মাঈন উদ্দিন কথা বলার জন্য ফ্লোর চান। কিন্তু আয়োজকগণ তাকে সুযোগ দিতে অস্বীকার করেন। তারা বলেন, তাদের আলোচক নির্দিষ্ট, বাইরের লোকদের কথা বলার সুযোগ নেই।

এ পর্যায়ে মাইনুদ্দীন উঠে দাঁড়িয়ে কথা কথা বলার জন্য ফ্লোর দাবী করে বলেন, এখানে একতরফা, মিথ্যা কথা, বাংলাদেশ সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী কথা বলা হয়েছে যার জবাব দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। এ নিয়ে আলোচনা সভায় প্রবল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এ পর্যায়ে কমরেড খালেকুজ্জামানের অুনরোধে আয়োজকগণ মাইনুদ্দীনকে দুই মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ দেন।

এরপর মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন সাজানো, সৃজিত বক্তব্য দেওয়া হয়। এসব সৃজিত বক্তব্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। তিনি দাবি করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যে সমস্যা, তা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, সরকার বা বাঙালি সৃষ্টি করছে না। সেখানে অন্যতম একটি সমস্যা ভূমি সমস্যা। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন সম্পূর্ণ একতরফা কাজ করছে।

আলোচনা সভায় বাঙালিদের সেটেলার বলার প্রতিবাদ করে তিনি বলেন, শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য বাঙালিদের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির মূল কারণ চারটি উপজাতীয় সংগঠনের সশস্ত্র কর্মীরা। মাইনুদ্দীন উপজাতি শব্দ বলায় উপস্থিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্যবৃন্দ ও আলোচকগণ প্রবল প্রতিবাদ করেন।

এ পর্যায়ে দ্বিতীয়বারের মতো আলোচনা সভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আয়োজকরা মাইনুদ্দীনকে ঘিরে ধরেন, তাকে ধমকি দিতে শুরু করেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের অনুরোধে পরিস্থিতি শীতল হলেও মাইনুদ্দীনকে আর বক্তব্য রাখতে দেয়া হয়নি।

জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ লেখক সমিতির সভাপতি হাসিবুর রহমান, মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পক্ষে নাসিরউদ্দিন এলান, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ইকবাল কবির, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুনয়ন চাকমা প্রমুখ।

Exit mobile version