জীবন্ত পুড়ছে রোহিঙ্গারা, শিশুদের গলা কাটছে সেনাবাহিনী: প্রত্যক্ষদর্শী

বাধন অধিকারী

পাহাড় বেয়ে ভেসে আসছে বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দ। পুড়িয়ে দেওয়া গ্রামগুলো থেকে আগুনের ধোঁয়া এসে মিশছে মৌসুমী বাতাসে। সেই ধোঁয়া মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠা রাখাইনের আকাশকে করে তুলছে বিবর্ণ ধূসর। রোহিঙ্গা জীবনে আরও বেশি ধূসরতা। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ছেন সেনারা। কখনও কখনও কেটে ফেলা হচ্ছে তাদের গলা। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে মানুষকে। জাতিসংঘ নিরাপত্তাজনিত কারণে ত্রাণ সরবরাহ স্থগিত করেছে। পরিস্থিতিকে তারা দেখছে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অভিমত, মিয়ানমার আদতে রোহিঙ্গাদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে প্রভাবশালী দুই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ এবং দ্য গার্ডিয়ান পৃথক দুই প্রতিবেদনে তুলে এনেছে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’র এই করুণ আখ্যান।


সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে সেনা মোতায়েন শুরু হতেই রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ শুরু করে। রোহিঙ্গা-স্রোত জোরালো হয় সেখানকার পুলিশ চেকপোস্টে হামলার পর। সেনা অভিযান শুরুর কয়েকদিনের মাথায় মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকার এক বিবৃতিতে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) রাখাইন রাজ্যের ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গা’রা ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে। দাবি অনুযায়ী রাতভর সংঘর্ষে রোহিঙ্গা-পুলিশ-সেনাসদস্য মিলে অন্তত ১০৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় সেনাসূত্র। এরপরই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান জোরদার হওয়ায় শরণার্থী স্রোতও জোরালো হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর তাদের সবশেষ হিসেবে জানিয়েছে, ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।

বিশ্বের সবথেকে ভাগ্যহারা নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। টিকে থাকার সহজাত মনুষ্য-প্রবৃত্তিই রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে নিয়ে আসছে বাংলাদেশ সীমান্তে। কেন ছুটে আসছেন তারা? গার্ডিয়ান তাদের এক প্রতিবেদনে তুলে এনেছে বিপন্ন রোহিঙ্গা জীবনের সকরুণ আখ্যান।

বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের একটি অংশ বাইছড়ি পাহাড় অঞ্চল। পাহাড়ে হেঁটে বেড়ান বাংলাদেশের ১৯ বছর বয়সী তরুণ সাখাওয়াৎ। সাখাওয়াৎ গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাকে বলেছে যে, কোনও বাছবিছার ছাড়াই তরুণদের দেখলেই নির্বিচারে তাদের হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনারা।’ সাখাওয়াৎ আরও জানান, হরহামেশাই মায়ের কোল থেকে রোহিঙ্গা শিশুদের কেড়ে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দিচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা। গার্ডিয়ানের কাছে তিনি দাবি করেছেন, অন্তত ৪ টি গ্রামের মানুষের কাছে তিনি এ কথা শুনেছেন।

শুক্রবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গেল এক সপ্তাহে উত্তর-পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে ৪শ জন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকারের সেনাবাহিনী নিহত ৪শ জনের মধ্যে ৩৭০ জনকে সন্ত্রাসী বলে উল্লেখ করেছে। তবে রাখাইন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ব্যাংককভিত্তিক এক মানবাধিকার সংগঠন ফোর্টিফাই রাইটস দাবি করেছে, সিত্তি জেলার রাতারডাং-এর চাট পিং গ্রামে ১৪০০ মানুষের মধ্যে ২০০ জনকে এরইমধ্যে হত্যা করা হয়েছে বলে সেখানকার জীবিতরা জানিয়েছেন।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি- নামের সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী সংগঠনকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রচার করে মিয়ানমার। বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের সমস্ত অভিযোগ ও ক্ষেত্রবিশেষে তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ সত্ত্বেও মিয়ানমার বেসামরিক হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, এআরএসএ’র মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধেই তাদের অভিযান। তবে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘আসলে মিয়ানমার আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে ভয় পায়। গ্রামে ওরা থাকলে মিয়ানমারের সেনারা হামলার সাহসই পায় না। গ্রামে তখনই হামলা হয়, যখন সেখানে কেবল নিরস্ত্র বেসামরিকরা থাকে। ওই বিজিবি সদস্য গার্ডিয়ানের কাছে দাবি করেন, আদতে বেসামরিকদেরই হত্যার টার্গেট নেওয়া হয়েছে।

কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের কাছাকাছি এক রাস্তায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিলেন মোহাম্মদ আমীন নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ। গার্ডিয়ানকে তিনি জানান, ‘জমিতে কাজ করার সময় মিয়ানমারের সেনারা আমার পায়ে গুলি করে। স্ট্রেচারে করে আমি বাংলাদেশে এসেছি।’ যে গ্রাম থেকে আমীন এসেছেন সেখানে আর কেউ নেই বলে জানিয়েছেন তিনি। ৫দিন ধরে পাহাড়-ঘেষা বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছেন আজি রহমান। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী গুলি করতে করতে এগিয়ে যায়। আমার ভাইয়ের মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।’

টেলিগ্রাফ মানবাধিকার সংগঠনর ফোর্টিফাই রাইটস-এর বরাত দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা এবং শিশুদের গলা কাটার তথ্য হাজির করেছে। চাট পিং-এর ৪১ বছর বয়সী আব্দুর রহমান ওই মানবাধিকার সংগঠনকে বলেছেন, ‘আমার ভাইকে মেরেছে সেনারা। অনেকের সঙ্গে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।’ তিনি আরও জানান, ‘আমাদের অপর এক স্বজনের মরদেহ আমরা মাঠের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পেয়েছি। আমার ছোট্ট দুই ভাগ্নেকে গলা কেটে মেরেছে সেনারা।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আশরাফুল আজাদ বিপন্ন রোগিঙ্গাদের পরিস্থিতিকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজাদ বলেন, ‘মিয়ানমার আসলে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে চায়। যা চলছে তা স্পষ্টত গণহত্যা’। গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘সমস্যাটা হলো কেউই এই সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য গ্রহণযোগ্য কোনও রাস্তা দেখাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা জোরালো নয়। আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনও বন্ধুও নেই।’

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তা ভিভিয়ান ট্যান বলেছেন, যে ভাবে লোক আসছে তাতে আর কয়েক দিনেই সীমান্তে যে শিবিরটি আছে তা পুরো ভরে যাবে।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক রাথেংডাংয়ে একদিনেই শতাধিক বেসামরিক হত্যার অভিযোগ উঠেছে। এরআগে গত বছরের অক্টোবরে সংঘটিত সামরিক অভিযানের সময়ে জাতিসংঘের তরফ থেকে মিয়ানমারের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। সেখানকার পরিস্থিতিকে তারা আখ্যা দেয় ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগও তুলেছিল। আর রাখাইন রাজ্যের সাম্প্রতিক সহিংসতায় ৪০০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে রাখাইন-পরিস্থিতিকে মানবিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা বলে আখ্যা দিয়েছে সংস্থাটি। এর কিছু সময় পরে রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত রাখাইনে ত্রাণ সরবরাহ স্থগিতের ঘোষণা দেয় জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম ডাব্লিউএফপি। এতে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা অনিশ্চয়তায় পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন