জীবন-সংগ্রামে হার না মানা নাম ‘রমজান’

fec-image

পৃথিবীতে হার না মানা কিছু মানুষ থেকেই যায়। তাদের জীবনটা গড়ে উঠে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। তাদের গল্প কখনো কখনো ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই হয়; না হয় কালের ধূলায় হারিয়ে যায় তাদের গপ্প। তাদেরকে কেউ কেউ জীবন সংগ্রামের হিরো বলে আখ্যায়িত করে। ইতিহাস বলে, যারা ব্যতিক্রম ভাবে নিজের জীবনকে আলোকিত করতে পেরেছেন তাদের নাম ইতিহাসে লেখা হয় স্বর্ণাক্ষরে।

আজ যাকে নিয়ে কথা; তিনি হয়তো সমাজে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারিনি। তবে তার পরিবারের কাছে তিনি মহান পুরুষ। জীবন সংগ্রামে তিনি হার না বীর, সেই কথা অকপটে বলা যায় বৈয়কি।

তার নাম রমজান আলী। বয়স পঞ্চান্ন ছুঁই ছুঁই। ভাসমান অবস্থায় রাস্তায় কলা বিক্রি করে জীবনের চাকা ঘুরান। প্রতিবন্ধী হয়েও জীবন সংগ্রামে মাথা নত করেননি। ভিক্ষার ঝুলিও হাতে তুলে নেয়নি। সম্পূর্ণ মেহনত, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, নিজের রক্ত পানি করে হালাল রুজি দিয়ে নিজের বউ-বাচ্চদের মুখে আহার তুলে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

বর্তমানে পেশায় একজন ভাসমান কলা বিক্রেতা। ব্যবসা করেন, রাঙামাটি শহরের বনরূপা এলাকার মূল সড়কের পাশ ঘেঁষে। এক সময় ভাসমান টং দোকান নিয়ে সেখানে কলা ব্যবসা করলেও টং দোকানগুলো উচ্ছেদের কারণে অন্য জায়গায় সালামী দিয়ে দোকান নেওয়া তার পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। তাই জীবনের তাগিদে পেটের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণে, পরিবারের সদস্যদের মুখে অন্য তুলে দিতে সড়ককে বেছে নিয়েছেন ব্যবসার মূল ঠিকানা।

প্রতিদিন হাজার দেড়েক টাকা কলা বিক্রি করেন এবং লাভ করেন ২৫০-৩০০টাকার মতো। অনেক সময় লাভের টাকা ঘরে তোলা মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মহামারী করনো তার ব্যবসাকে ধসে দিয়েছে। তাই তো তিনি করোনা কি না বুঝলেও করোনার কারণে তার ব্যবসার বারোটা বেঁজেছে সেটা হারে হারে ঠের পেয়েছে।

অতীতে তিনি একটি দোকানের ম্যানেজার ছিলেন। পরবর্তী ২০১১ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় তার একটি পা অচল হয়ে পড়ে। ক্রাচে ভর দিয়ে চলাচল করতে হয়। দীর্ঘ বছর চিকিৎসা করার পরও তার পা ভাল হয়নি। কিন্তু জীবন সংগ্রামে হার মানেননি। তিনি চাইলে ভিক্ষা বৃত্তি করে জীবন চালাতে পারতেন। সেই পেশা তিনি বেঁচে নেয়নি। জীবনে বাঁঁচার জন্য ব্যবসাকে মূল ক্ষেত্র হিসেবে বেঁচে নিয়েছেন।

তার ভাষ্য-ভিক্ষা বৃত্তি কোন ভাল পেশা নয়। যতক্ষণ বেঁচে আছি মেহনত করে আয় করবো।এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম এইবার সেই রমজানের মুখে শুনবো তার কথা। রমজান বলেন, পা হারানোর পর ক্রাচে ভর করে চলাচল করি। খুব কষ্ট হয় কিন্তু করার কিছু নেই। বাড়িতে বউ এবং তিনটা মেয়ে রয়েছে। তাদের মুখে অন্ন দিতে বের হতে হয়। করোনার কারণে ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। করার কিছু নেই, ব্যবসা ঠিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালচ্ছি। কারণ ব্যবসা না করলে বউ-বাচ্চার মুখে আহার তুলে দেওয়া সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, বড় মেয়ে অষ্টম শ্রেণীতে, মেঝ মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে এবং ছোট মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। থাকি ভাড়া বাসায়। মেয়েদের লেখা-পড়ার খরচ, বাড়ি ভাড়া এবং নিজেদের খাবার খরচ সবকিছু আমার ব্যবসার আয় দিয়ে চলে। একদিন ব্যবসা না চললে ঘরের অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে। করোনার এমন দুর্যোগে ঘরের পরিবেশ আরও ভয়ংকর হয়েছে।

রমজান জানান, এমনিতে আমার পা একটি অচল। হাটের ঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠে কলা ক্রয় করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। যে কারণে দ্বিতীয় পক্ষ থেকে ক্রয় করে বনরূপা বাজারে এনে বিকিকিনির কাজটা করি। তাই লাভ হয় সীমিত। জীবন তো চালাতে হবে। বাঁচতে হলে কাজ করতে হবে।

রমজান আরও জানান, প্রায় একমাসের মতো আমি খুব কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। তবে এর মধ্যে কয়েকজন আমাকে ত্রাণের চাল, ডাল দিয়ে সহয়তা করেছেন। তবে এই দিয়ে তো একমাস চলা সম্ভব না।

আমি ভিক্ষা চাই না। হার ভাঙ্গা মেহেনত করে খেতে চাই। সেইজন্য যত তাড়াতাড়ি করনো চলে যাবে তত তাড়াতাড়ি আমার ভাগ্যর চাকা ঘুরবে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রাঙামাটি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন