জুমের আগুনে জ্বলছে বান্দরবানের পাহাড়: ধ্বংসের মুখে বনাঞ্চল,আশ্রয়স্থল হারাচ্ছে বন্যপ্রাণী

Untitled-1

নিজস্ব প্রতিবেদক:
জুমের আগুনে পুড়ছে বান্দরবান। আদি পদ্ধতিতে বান্দরবানে শত শত পাহাড়ের ঝোপ-জঙ্গল, গাছপালা কেটে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে জুম চাষের জন্য। পাহাড়ি জুমিয়া পরিবারগুলোর লাগানো আগুনে পার্বত্যাঞ্চলের সবুজ শ্যামল প্রকিৃতি পুড়ে সৃষ্টি হয়েছে নেড়া পাহাড়। কয়েক সপ্তাহ থেকে বান্দরবান-রুমা-থানছি সড়কের আশেপাশে অসংখ্য পাহাড় জুম চাষের জন্য আগুনে পোড়াতে দেখা গেছে। বছরের পর বছর পাহাড়ে আগুন দিয়ে জুম চাষের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীজ সম্পদ।

জুমিয়া পরিবারগুলো পাহাড়ে আগুন দিয়ে আদিপদ্ধতিতে জুম চাষ করে সারা বছরের খাদ্য শস্য ঘরে তুলতে পারলেও জুমচাষ প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিপন্ন করার পাশাপাশি মাটি ক্ষয় এবং প্রাণীজ সম্পদের খাদ্য ও বসবাসের আশ্রয়স্থলও ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ কারণে পাহাড়ে পরিবেশ সম্মতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত দশ বছরে জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানছিসহ সাত উপজেলায় আগুনে পুড়ে মারা গেছে অন্তত ১৫ জন। পুড়েগেছে কয়েকশ ঘরবাড়ি।

কৃষি বিভাগসহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে এবার বান্দরবানে সর্বাধিক জমিতে জুম চাষের প্রস্তুতি নিয়েছে পাহাড়িরা। বান্দরবান জেলায় প্রায় ১১ হাজার হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলা সদরের ডলুপাড়া, গেজমনি পাড়া, শৈলপ্রপাত, যৌথখামার এলাকা, কানাপাড়া, মেঘলা, মাঝেরপাড়া, আমতলীপাড়া, সাতকমলপাড়া, ফারুকপাড়া, বান্দরবান-চিম্বুক, বান্দরবান-রোয়াংছড়ি, বান্দরবান-রুমা-থানছি সড়কসহ জেলার সাত উপজেলায় শত শত পাহাড়ে জুম চাষের প্রস্ততি নিয়েছে পাহাড়িরা।

গত শুক্রবার বান্দরবান-রুমা-থানছি সড়ক ঘুরে দেখা গেছে পাহাড়িদের লাগানো জুমের আগুনে পুড়ছে অসংখ্য পাহাড়। আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের সবুজ শ্যামল পাহাড়গুলোর ঝাড়-জঙ্গল, গাছ-পালা কেটে নির্বিচারে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পাহাড়গুলোকে জুম চাষের উপযোগী করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আগুনে পোড়ানো পাহাড়গুলো পরিষ্কার করে জুম চাষের প্রস্তুত করতেও দেখা গেছে জুমিয়া পরিবারদের।

মূলত বছরের এপ্রিলের শেষ দিকে আর মে মাসের শুরুর দিকে জুমিয়ারা পাহাড়ে আগুন দেয় এবং মে-মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। চিম্বুক সড়কের বাসিন্দা লংগান ম্রো এবং খানসামার বাসিন্দার অংহ্লাচিং মারমা জানিয়েছেন, পাহাড়ে জুম চাষ তাদের পূর্ব পুরুষের আদিপেশা। তারাও জুম চাষের মাধ্যমে সংসার চালায় এবং বছরের খাদ্য সামগ্রী মজুদ করে। জুমে পাহাড়ি ধান, ভূট্টা,মরিচ, যব,সরিষা, মিষ্টি কুমড়া,টকপাতা,মরিচ, এবং আদাসহ বিভিন্ন রকম সবজির চাষ করে।

কৃষি বিভাগ এবং মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জুম চাষ। পাহাড়ে জুমিয়া পরিবারদের লাগানো আগুনে গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী মরে যাচ্ছে। মাটি ক্ষয় হয়ে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। সবুজ পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে। তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে গাছপালা, বন্যপ্রাণী এবং পাহাড়ধস রোধ করা সম্ভব হবে। জুম চাষের মাধ্যমে আরো অধিক ফলনও উৎপাদন সম্ভব হবে।

মৃত্তিকা ও পরিবেশবাদী সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, জুম চাষের ফলে বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়ে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অন্যদিকে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। পাশাপাশি বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস হচ্ছে এবং ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এ কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। ভূমি অবক্ষয় সম্পর্কিত একজরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট পাহাড়ি ভূমির প্রায় ১৭ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি এখন ক্ষয়ের মুখে। তার জন্য প্রধানত জুম চাষকে দায়ী করা হয়েছে।

১৯৯২ সালে অপর এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমিক্ষয়ের মাত্রা অত্যন্ত বিপজ্জনক। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী পার্বত্যাঞ্চলে প্রতি হেক্টরে ১০০ থেকে ১২০ টন মাটি ক্ষয় হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইইসিএন সংস্থার মতে দুর্গমাঞ্চলে ১৯৬৪ হতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২১ বছরে মৃত্তিকা সম্পদ শতকরা ১৮ ভাগ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। উপরোক্ত সংস্থাগুলোর জরিপে ভূমিক্ষয়ের জন্য পাহাড়ের জুম চাষকেই প্রধানত দায়ী করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কালাম জানান, জুম চাষ পরিবেশগতভাবে ক্ষতি হলেও সুফলও আছে। চলতি মৌসুমে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর পাহাড়ে জুম চাষের প্রস্তুতি চলছে। জুমে ধানের পাশাপাশি মারফা, মরিচ, ভূট্টা, সরিষা, যব, তিল ও তুলাসহ বিভিন্ন ধরনের অর্থকরী ফসল উৎপাদন হয়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিবেশ সম্মতভাবে জুম চাষ করলে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর কোন ধরনের প্রভাব পড়বে না। তবে বর্তমান পদ্ধতিতে জুম চাষ অব্যাহত থাকলে আগামী একদশকে সবুজ বনাঞ্চল সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস হয়ে যাবে।

লেখক ও গবেষক সিংইয়ং ম্রো জানান, জুম চাষ আগের তুলনায় অনেক কমেছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি সম্প্রদায়রা জুম চাষ করে আসলেও ইদানিং মিশ্র ফল চাষের দিকে ঝুঁকছে। তবে সর্বক্ষেত্রে অবহেলার শিকার ¤্রাে জনগোষ্ঠীরা এখনো পুরোপুরি জুম চাষের উপর নির্ভরশীল। অন্যান্য সমপ্রদায়ের লোকজনের মধ্যে জুমচাষের প্রবনতা অনেকাংশে কমে গেছে। জুম চাষের মাধ্যমে জুুমিয়া পরিবারগুলো সারাবছরের খাদ্য সংগ্রহ করলেও এটি পার্বত্য চট্রগ্রামের বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐহিত্য-সংস্কৃতির একটিও অংশ।

বান্দরবান মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ বলেন, আদি পদ্ধতিতে চাষ পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। জুমিয়া পরিবারের লাগানো আগুনে জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছে পাহাড়গুলো। পাহাড়ের সবুজ গাছপালা এবং বন্যপ্রাণী মরে যাচ্ছে। মাটি ক্ষয় হয়ে অল্প বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আশঙ্কা বাড়ছে দিন দিন। সবুজ পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিণত হচ্ছে।

তারা বলেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে গাছপালা, বন্যপ্রাণী ও পাহাড়ের ধস রোধ করা সম্ভব। এ পদ্ধতিতে আরও অধিক ফলনও সম্ভব। রোয়াংছড়ি সদরের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান অংসুই মং মারমা বলেন, জুমিয়াদের লাগানো জুমের আগুনে ঘরবাড়ি ছাড়াও ২০১২ সালে রোয়াংছড়িতে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজন মারা যায়। গত দশ বছরে জেলার বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে পনের জনের মৃত্যু হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন