জুমের পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত বান্দরবানের পাহাড়ীরা

জমির উদ্দিন:

পাহাড়ে চলছে জুম উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে পাহাড়ে জুম ক্ষেতে এখন পাকা ফসল তোলার ভরা মৌসুম। জুমিয়ারা ঘরে তুলছে সেই সোনালী ফসল। জুমের বাম্পার ফলনে পাহাড়ে ধান কাটার আনন্দে মেতেছে ম্রো, বম সম্প্রদায়সহ পাহাড়ী নারী-পুরুষেরা। শিশু কিশোর, বাবা-মা কেউই বসে নেই ঘরে। পরিবার-পরিজন নিয়ে পাহাড়ী জুমিয়া পরিবারেরা সকলে ধান কাটতে নেমেছে পাহাড়ে। তবে বিগত বছরের তুলনায় এবার জেলায় প্রায় আট হেক্টর পাহাড়ী জমিতে জুম চাষ কমেছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগ। গত বছর বান্দরবান জেলায় ৮ হাজার ৪৪৭ হেক্টর পাহাড়ী জমিতে জুম চাষ হয়। কিন্তু চলতি বছর জুম চাষ হয়েছে ৮ হাজার ৪৩৯ হেক্টর জমিতে।

কৃষি বিভাগ ও জুম চাষীদের সূত্রে জানা গেছে, পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসরত পাহাড়ীরা প্রতিবছর জেলার বিভিন্ন এলাকায় শত শত পাহাড়ে জুম চাষ করে। একই পাহাড়ে একাধিকবার জুম চাষ করা যায় না বলে জুমিয়ারা প্রতিবছর ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে জুমের চাষ করে। জেলায় বসবাসরত মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, খুমী, লুসাই, পাংখো, বম, চাকসহ ১১টি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর অধিকাংশরাই জুম চাষের উপর জীবন জীবিকা নির্ভরশীল। জেলা শহরে বসবারত কিছু সংখ্যক শিক্ষিত পরিবার ছাড়া দূর্গমাঞ্চলে পাহাড়ে বসবাসরত পাহাড়ীরা আজও জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তবে ১১টি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে একমাত্র ম্রো সম্প্রদায় আদিকাল থেকেই জুম চাষের মাধ্যমেই সারা বছরের জীবিকা সংগ্রহ করে।

জুমিয়া পরিবারগুলো প্রতিবছর বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়। মে-জুন মাসের দিকে আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। প্রায় ৩/৪ মাস পরিচর্যার পর বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পাহাড়ে জুমের ধান কাটা শুরু করে। চলতি মৌসুমেও বান্দরবান জেলায় প্রায় ৮ হাজার ৪৩৯ হেক্টর পাহাড়ী জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। তার মধ্যে সদর উপজেলায় ৫৮৭ হেক্টর, রোয়াংছড়ি উপজেলায় ৩২৬ হেক্টর, রুমা উপজেলায় ১ হাজার ৮৭৫ হেক্টর, থানছি উপজেলায় ২ হাজার ৮৪৭ হেক্টর, লামা উপজেলায় ১ হাজার ২১৭ হেক্টর, আলিকদম উপজেলায় ৯১২ হেক্টর এবং নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ৭১৫ হেক্টর।

পাহাড়ী জুম চাষী একাদিক জন জানিয়েছেন, এবার জেলার রুমা, থানছি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, রোয়াংছড়ি এবং বান্দরবান সদর উপজেলার ডলুপাড়া, মেঘলা, শৈলপ্রপাত, ফারুক পাড়া, কানাপাড়া, শ্যারণ পাড়া, ওয়াইজংশন, পোড়া পাড়া, হাতিভাঙ্গা পাড়া, গেজমনি পাড়া, কানাপাড়া, ডলুপাড়া, সাতকমল পাড়ায় জুমের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার জুম চাষ অনেকাংশে কমে গেছে। জুমের পাঁকা ধানের গন্ধ ছড়াচ্ছে এখন সবখানে। জুমের পাঁকা ধান ঘরে তুলতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন পাহাড়ী জুমিয়া পরিবারগুলো। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত এবং আবাহাওয়া জুম চাষের অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে জুমের ভাল ফলন হওয়ায় জুমিয়া পরিবারগুলো ভিশন খুশী। বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের দুপাশের পাহাড়ের এখন শুধু পাঁকা ধান। স্ত্রী পরিবার-পরিজন নিয়ে জুমিয়া পরিবার গুলো নেমে পড়েছে জুমের ধান কাটতে। বাবা-মায়ের সাথে ধান কাটছে পাহাড়ী শিশুরাও। জুম চাষ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ক্ষতি করলেও পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর কাছে এটি ঐতিহ্য। জুমিয়ারা পাহাড়ে ধানের পাশাপাশি ভূট্টা, মরিচ, যবসরিষা, মিষ্টি কোমড়া, মারমা, টকপাতাসহ বিভিন্ন রকম সবজির চাষ করে।

বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের শস্য উপাত্ত উৎপাদন বিশেষজ্ঞ আলতাফ হোসেন জানান, আদি পদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে পাহাড়ের ক্ষয়সৃষ্টি হচ্ছে এবং জমির উর্ব্বরা হ্রাস পাচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে জুমিয়ারাও লাভবান হবে। অপরদিকে জুমের ধান কাটার সময়টা পাহাড়ীরা নবান্ন উৎসব হিসেবেও পালন করে। পাহাড়ে জুমের ফসল ঘরে তোলার পাশাপাশি পাহাড়ী পল্লীগুলোতে চলছে নবান্ন উৎসবের প্রস্তুতি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন