parbattanews

জুম ফসলে হাসি ফুটেছে জুমিয়াদের মুখে

Jum

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর জীবনযুদ্ধের অন্যতম সহায়ক মাধ্যম হচ্ছে জুমচাষ। রোদ-বৃষ্টির তীব্রতা উপেক্ষা করে নারী-পুরুষের কঠিন পরিশ্রমে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে এখন সবুজের সমারোহ। সারা বছর পরিশ্রম শেষে পাহাড়ী তরুনীরা যখন জুম ক্ষেতের পাকা ফসল ঘরে তুলতে যায় যখন মনের আনন্দে জুম ঘরের মাচায় বসে জুম্ম তরুন -তরুনীরা একটি গেয়ে থাকে। গানটির বাংলা অর্থ হলো: “পাহাড়ী মেয়েটি জুমে যায় রে                                                                                                       যেতে যেতে পথে পথে পিছন ফিরে চায়                                                                                            পাকা শস্য দেখে তার বুকটা জুড়ায়।”                                                                                               -এটি চাকমা সম্প্রদায়ের প্রিয় একটি গান।

জুমে বীজ বপনের পাঁচ মাস পরিচর্যা ও রক্ষাণাবেক্ষণের পরে উৎপাদিত ফসল দেখে হাসি ফোটে জুম চাষীদের মুখে। তাই জুম ক্ষেত থেকে ফসল ঘরে আনা শুরু হতেই উৎফুল্ল হয়ে পড়ে জুমিয়া নারী-পুরুষেরা। কিছু কিছু জুম চাষীর ঘরে নবান্ন্ উৎসবের আয়োজনও শুরু হয় এ সময়ে। বিশেষ করে, পাহাড়ি নারীরা সবুজের মায়ায় যেন উতলা হয়ে ছুটে যায় জুমক্ষেতে।

ফসলে ভরা জুমক্ষেত- পাহাড়ের ঢালুতে সকালের শিশির ভেজা ধান, ভুলিয়ে দেয় অতীতের সব পরিশ্রম ও ক্লান্তি। সবুজের প্রশান্তিতে জাগ্রত আজ তাদের মন, তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয় জুমের প্রেমে সবাই পাগলপারা। জীবন সংগ্রামে পাহাড়ি কিশোরীরাই জুমের প্রেমে মশগুল, পিতামাতাকে সাহায্য করতে ঘরে বসে থাকতে দেখা যায় না তাদের। ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি নারীদের, সূর্য ওঠার আগেই তারা ছুটে যায় জুমের টংঘরে। সারাদিন সেখানেই কাটে তাদের। সূর্যকে বিদায় জানিয়ে অন্ধকার নামার পরে ঘরে ফিরে আসে জুম চাষিরা। কখনো আবার চাঁদের আলোয় পথ খুঁজে তারা ঘরে ফেরে। কখনো কখনো নিঝুম অন্ধকারকে সঙ্গী করেই রাত কাটাতে হয় টংঘরে।

জুমিয়ারা জুমে বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে থাকে। তার মধ্যে ধান, যব, ভূট্টা, মার্ফা, করলা, মরিচ, মাটিআলু, ঠান্ডাআলু, মিষ্টিকুমড়া, আদাসহ বিভিন্ন ফসল। প্রতিটি টংঘরের চালে থাকা চালকুমড়া।

এবার উপজেলার বেশিরভাগ পাহাড়েই ভালো ফলন হয়েছে। আর কদিন পরেই পাকা ধান ঘরে উঠবে। এ মৌসুমে উপযুক্ত জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের কারণে এবং ইদুঁর ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব না থাকায় ও সঠিক বৃষ্টিপাতের কারণে জুমের ফলন ভালো হয়েছে। তবে জুম চাষীদের চোখে-মুখে কিছুটা আনন্দ দেখা দিলেও অল্প পরিমাণ জায়গায় জুম চাষ করে বছরের খোরাকি না হওয়ায় চিন্তিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মাটির উর্বরতা হ্রাসের কারণে পাহাড়ে জুম চাষ কমে গেছে। একই পাহাড়ের মাটিতে বার বার জুম চাষ করায় এখন আর আগের মত জুমে ভালো ফলন হয় না। তাছাড়া জুমে এখন সার প্রয়োগ না করলে ভালো ফলন পাওয়া যায় না।

জুম চাষী পাপলু চাকমা বলেন, জুম চাষের জন্য পাহাড়ে জায়গা স্বল্পতা হওয়ায় এবং পাহাড়ের একই জায়গার মাটিতে বার বার চাষ করায় মাটির উর্বরতা কমে গেছে। বিগত বছরে পর পর দুই বছর খরা ও বৃষ্টিপাতের অভাবে জুমের ফলন তেমন ভাল হয়নি। তবে এবছর কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাতের ফলে সময় মতো জুম চাষ সম্ভব হয়েছে। ফলনও হয়েছে আশাতীতভাবে। ধান কাটা, মাড়াই ও ঝাড়াইয়ের পর হেক্টর প্রতি ১.৮ টন ফলন পাওয়া গেছে। তাই এবারে কিছু পরিমাণ ধান বাড়ীতে তুলতে পারবো।

তবে যে মুহূর্তে জুমের পাকা ধানসহ উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলা শুরু হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে ভারি বৃষ্টির কারণে নানা সমস্যা দেখা দেয়। কয়েকজন জুম চাষি জানান, আমাদের এতদিনের আনন্দ-পরিশ্রম নষ্ট হতে বসেছে কারণ এই বৃষ্টি কিছু ফসলের জন্য ভালে হলেও বড় ক্ষতি হচ্ছে এ মৌসুমের পাকা ধানের জন্য। এভাবে যদি আরো কিছুদিন ঝড়-বৃষ্টি হতে থাকে তাহলে আমাদের সব পাকা ধান নষ্ট হয়ে যাবে।

রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় এ বছর ৪ হাজার ৭৬০ হেক্টর জায়গায় জুম চাষ করেছে জুমিয়ারা। প্রতি হেক্টর জমিতে ১.৮ মেট্টিক টন জুমের ফসল হয়েছে। এবছর সঠিক বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়া অনুকুলে থাকার কারণে রাঙামাটিতে মোট ৫ হাজার ৮মেট্টিক টন জুমের ফসল পাওয়া গেছে।

লংগদু উপজেলাধীন ভাসান্যাআদম ইউনিয়নের মেম্বার আমির হোসেন জানান, এখন আর আগের মত জুম চাষ হচ্ছেনা। পাহাড়ি অঞ্চল থেকে দিন দিন জুম চাষ উঠে গিয়ে তা মৌসুমি ফলের ক্ষেতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
এখন আধুনিকায়নের ফলে জুম চাষ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। জুমচাষের আদিপ্রথা কালের বিবর্তনে দিন দিন শুধু পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই পরিবর্তনে যুক্ত হচ্ছে স্বল্প মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী ফসল চাষ।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দবানের উপজাতিদের জুম ক্ষেতে সবেমাত্র শুরু হয়েছে পাকা ধান কাটা। ধুম পড়েছে মারফা (পাহাড়ী শশা), ছিনারগুলা (পাহাড়ী মিষ্টিফল), বেগুন, ধানি মরিচ, ঢেড়ঁশ, কাকরোল, কুমড়াসহ ইত্যাদি ফসল তোলার কাজ। এরপর ঘরে উঠবে তিল,যব, এবং সবশেষে তোলা হবে তুলা। উপজাতি জুমচাষীরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল পরিষ্কার করে করে শুকানোর পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে জুম ক্ষেত প্রস্তুত করে । এরপর বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে পোড়া জুমের মাটিতে শুঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুড়ে একসঙ্গে ধান, তুলা, তিল, কাউন, ভুট্টা, ফুটি, চিনার, যব ইত্যাদি বীজ বপন করে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে জুমের ফসল পাওয়া শুরু হয়। সে সময় মারফা (পাহাড়ী শশা), কাঁচা মরিচ, চিনার ,ভুট্টা পাওয়া যায়। ধান পাকে ভাদ্র- আশ্বিন মাসে। সবশেষে তুলা, তিল,যব ঘরে তোলা হয় কার্ত্তিক-অগ্রহায়ন মাসে।

রাঙামাটি সদর উপজেলার বরাদম ইউনিয়নের গোলাছড়ি এলাকার অর্পনা চাকমা জানিয়েছেন, গতবারের চেয়ে এবার তার জুমের ফসল অনেক ভালো হয়েছে। মানিকছড়ি ইউনিয়নের আরেক জুমচাষী জানান, দেড় একরের মতো জায়গায় জুমচাষ করেছি। এ জুমে উৎপাদিত ফসল দিয়ে আমি আগামী ৭-৮ মাস পর্যন্ত আমার চলে যাবে। এর পাশাপাশি আমি হলুদ ও রোপন করেছি। এখান থেকে বেশকিছু অর্থ আমার উপার্জন হবে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো কৃষি বিভাগ থেকে আমরা কোন সহযোগিতা পাইনা। তাদের কাছ থেকে যদি কিছু সহযোগিতা পাই তাহলে আমরা ধান ও অন্যান্য ফসলও ভালোভাবে রোপন করতে পারবো।

পার্বত্য তিন জেলায় প্রতি বছর কত একর জায়গায় জুম চাষ হয় তার সঠিক হিসাব কৃষি বিভাগ জানাতে না পারলেও বিশেষ পদ্ধতির এ আদি জুম চাষ পার্বত্য উপজাতিদের জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস। এ ব্যাপারে রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ সাদির উদ্দীন বলেন, জুম ধানের সাথে ফসল হিসেবে কুমড়া জাতীয় ফসল চাষ না করাই ভাল। কারণ এতে করে কুমড়া জাতীয় গাছের লতা ও আকর্ষী দ্বারা ধান গাছ পেঁচিয়ে গাছের কিছুটা ক্ষতি হয়। প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য সার হিসেবে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ফসল থাকা অবস্থায় ডিবলিং পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে। এতে করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিসহ ফসল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। ফসল কাটার পর কলা ও পেঁপে গাছের বিশেষ যত্ন নিতে হবে যাতে করে সে সমস্ত বাগান থেকে পরবর্তীতে ভাল ফল পাওয়া যায়।

Exit mobile version