parbattanews

জেএসএসের আপত্তির কারণে টাক্সফোর্স থেকে বাঙালী উদ্বাস্তুদের বাদ দেয়া হয়

(গতকাল প্রকাশিতের পর)

বাঙালী বা অউপজাতীয় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তের সংখ্যা কতো?

অভ্যন্তরীণ বাঙালী বা অউপজাতীয় উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা পূর্বোল্লেখ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আনায়নের প্রচেষ্টার বিভিন্ন উদ্যোগ অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ অউপজাতীয় বা বাঙালী উদ্বাস্তুদের প্রাথমিক তালিকা পাওয়া ১৯৯৭ সালের ১২ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্পেশাল এফেয়ার্স বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে।

অর্থাৎ শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পূর্বেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক প্রশাসন জনাব মসিউর রহমান স্বাক্ষরিত এই প্রজ্ঞাপনে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে অভ্যন্তরীণ অউপজাতীয় উদ্বাস্তু পরিবারের সংখ্যা ৬১,২০২। এর মধ্যে রাঙামাটিতে ১৫,৬৭৩ পরিবার, বান্দরবানে ২৫৯ পরিবার এবং খাগড়াছড়িতে ৪৫,২৭০ পরিবার। এ তালিকা অনুসারে উপজাতীয় ও অউপজাতীয় মোট উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১,৪৯,৩৪০ পরিবার। যদিও শান্তিচুক্তির আওতায় গঠিত টাস্কফোর্সে কেবলমাত্র  অভ্যন্তরীণ উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের কথা বলা হয়েছে।

তবু কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ সকল জাতিগোষ্ঠীর মঙ্গল চিন্তায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি অউপজাতীয় বা বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে শান্তিচুক্তির পূর্ব থেকেই এবং পরবর্তীকালেও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সেকারণে উপজাতীয় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য গঠিত টাস্কফোর্স অউপজাতীয় বা বাঙালী অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। শুধু তাই নয়, টাস্কফোর্সের বিভিন্ন কমিটিতে বাঙালি সদস্যদের অন্তর্ভূক্তির নজির দেখা যায়- যা এখনো বহাল আছে।


এই সিরিজের আগের লেখাগুলো পড়ুন এখানে


টাস্কফোর্সের প্রথম কমিটি ৩৮ হাজার ১৫৬টি বাঙালী পরিবারকে অভ্যন্তরীণ অউপজাতীয় উদ্বাস্তু হিসাবে চিহ্নিত করে। ২০০৭ সালের ৩১ জুলাই টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত অপর এক তালিকায় অভ্যন্তরীণ অউপজাতীয় বা বাঙালি উদ্বাস্তুদের সংখ্যা ৩৮,১৫৬ পরিবার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরমধ্যে খাগড়াছড়িতে ২২৩৬৭, রাঙামাটিতে ১৫৫১৬ বান্দরবানে ২৬৯ পরিবার।

এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অউপজাতীয় বা বাঙালী উদ্বাস্তুর তালিকা ৬১,২০২ থেকে কী করে একলাফে ৩৮,১৫৬ তে নেমে আসলো তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই  প্রজ্ঞাপন প্রকাশের সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারই ক্ষমতায় ছিলেন এবং এতে স্বাক্ষর করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, তৎকালীন পরিচালক প্রশাসন হিসাবে।

তবে ২০০৯ সালের ৫ অক্টোবর খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত ভারত প্রত্যাগত শরণার্থিদের প্রত্যাবাসন ও পুণর্বাসন এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্ত নির্দিষ্টকরণ-পৃথক পুণর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুনগঠিত টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় অউপজাতীয় বা বাঙালী অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৫৭,৬৯২ পরিবার বলে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে খাগড়াছড়িতে ৪১,৯০৭ পরিবার, রাঙামাটিতে ১৫,৫১৬ পরিবার এবং বান্দরবানে ২৬৯ পারিবার বলে উল্লেখ রয়েছে। ২০০৭ সালের তালিকা থেকে ২০০৯ সালের তালিকায় রাঙামাটি ও বান্দরবানে বাঙালী উদ্বাস্তুর সংখ্যা সঠিক থাকলেও খাগড়াছড়িতে তা বেড়ে যায়। এই টাস্কফোর্সে সদস্য হিসাবেও অউপজাতীয় বা বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে এসএম সফি অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। তিনি এখনো আছেন, তবে অসুস্থতার কারণে নিষ্ক্রিয়।

২৭ জানুয়ারী ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এই টাস্কফোর্সের দ্বিতীয় সভায় জেএসএস প্রতিনিধি লক্ষীপ্রসাদ চাকমা অউপজাতীয় পরিবারকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসাবে অন্তর্ভূক্ত না করার দাবী জানান।  এসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি ও খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক অউপজাতীয়দের অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে এর প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব তুলে ধরে তাদের অন্তর্ভূক্তি যথাযথ হয়েছে মর্মে অভিমত প্রদান করেন। বৈঠকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের প্রতিনিধি বলেন, যিনি বাস্তু থেকে উৎখাত হয়েছেন তিনিই উদ্বাস্তু। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয় ও অউপজাতীয় সকলকে রাখা বাঞ্ছনীয়।

জেএসএসর আপত্তির কারণে বৈঠকে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা পাওয়ার জন্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটির নির্দেশনা চাওয়ার অভিমত গৃহীত হয়। ২৬ জানুয়ারি ২০১১ তে অনুষ্ঠিত কমিটির তৃতীয় বৈঠকেও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা হয় এবং শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য অপেক্ষার সিদ্ধান্ত জানানো হয়। তবে এই টাস্কফোর্সের চতুর্থ সভায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।  এরমধ্যে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা নির্ধারণে প্রথম টাস্কফোর্সের অধীনে ১৯৯৮ সালের ২৭ জুন অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত রয়েছে মর্মে জানানো হয়। এবং পূর্ববর্তী সভার সিদ্ধান্ত রয়েছে মর্মে জানার পর সভায় এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন নেই মর্মে মতামত ব্যক্ত করা হয় এবং উক্ত সিদ্ধান্তের আলোকে কার্যক্রম পরিচালনা করার বিষয়ে সকলে একমত পোষণ করেন।

উল্লেখ্য, এই টাস্কফোর্সের প্রণীত অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা হলো: ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৯২ সালের ১০ আগস্ট পর্যন্ত যে সকল উপজাতীয় ও বাঙালী নিজ গ্রাম, মৌজা ও অত্র অঞ্চল ত্যাগ করিয়া দেশের মধ্যে অন্যত্র চলিয়া যায় বা চলিয়া যাইতে বাধ্য হয়, তাহারাই অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু।’ ইত্তেফাক: ২৯-১১-২০০০ দ্রষ্টব্য।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে এই কমিটি অউপজাতীয় উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে স্ববিরোধী একটি সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্তে বলা হয়, ‘অভ্যন্তরীণ অউপজাতীয় শরণার্থিগণকে সরকার ভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারে’। এটি স্পষ্টতঃই পূর্বের সিদ্ধান্তের বিপরীত।

তবে ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরার নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের ৫ম সভায় আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেএসএস সভাপতি সন্তু লারমা অউপজাতীয় শরণার্থিদের পুনর্বাসনের বিষয়ে জোরালো আপত্তি তোলে এবং তার আপত্তির কারণে টাস্কফোর্সের কার্যতালিকা থেকে অউপজাতীয় বা বাঙালী উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বাদ দেয়া হয়। এরপর থেকে আর অভ্যন্তরীণ বাঙালী উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের উদ্যোগ হারিয়ে যায়। ফলে গুচ্ছগ্রামে ও গুচ্ছগ্রামের বাইরে বাস্তচ্যুত বাঙালীদের নিজ বসতভিটায় পুনর্বাসনের স্বপ্ন ভেঙে যায়।

শরণার্থি প্রত্যাবাসন বিষয়ক কর্মপরিকল্পনা বা ২০ দফা পুনর্বাসন কর্মসূচী

১৯৯৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ এবং ৬-৯ মার্চ ১৯৯৭ সালের ত্রিপুরায় অবস্থিত উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তৎকালীন চিফ হুইপ হাসানাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের শরণার্থি প্রত্যাবাসন বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০ দফা চুক্তি হিসাবে এই চুক্তি খ্যাত হয়। এই চুক্তি উপজাতীয় প্রত্যাবাসিত শরণার্থিদের পুণর্বাসনের জন্য ২০ দফা প্যাকেজ। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্পেশাল এফেয়ার্স বিভাগ এ ব্যাপারে ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তবে এই প্রজ্ঞাপন ১২ নভেম্বর ১৯৯৭ সালে সংশোধন করে আরো একটি প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়।

এই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, প্রত্যাবাসিত শরণার্থিদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা, গৃহ নির্মাণ ও কৃষি অনুদান বাবদ পরিবার প্রতি এককালীন ১৫ হাজার টাকা প্রদান, শরণার্থি প্রতি পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য প্রতি মাসে ৫ কেজি চাল, অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ২.৫ কেজি চাউল, ২ কেজি তেল, ৪ কেজি ডাল, ২ কেজি লবণ এক বছর পর্যন্ত রেশন হিসাবে দেয়া হবে। গৃহ নির্মাণ বাবদ পরিবার প্রতি ২ বাণ্ডিল ঢেউটিন, চাষাবাদ যোগ্য জমি রয়েছে এমন পরিবারের জন্য হালের বলদ কেনার জন্য ১০ হাজার টাকা, ভূমিহীন পরিবারের জন্য গাভী কেনার জন্য ৩ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ মওকুফ, অন্যান্য সরকারী ব্যাংকে ঋণ থাকলে তা মওকুফ, উন্নয়ন বোর্ড থেকে নেয়া ঋণ থাকলে তা মওকুফ করা হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ ক্ষমা বলবৎ করা হবে, ইনসার্জেন্সি সংক্রান্ত মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানার ক্ষেত্রেও একটি প্রয়োজ্য হবে। প্রত্যাবাসিত শরণার্থিদের মালিকানাধীন জমি তাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। তাদের গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসন করা হবে না। দেশত্যাগের পূর্বে যেসব শরণার্থি সরকারী/আধা সরকারী সংস্থায় কর্মরত ছিলেন তাদের চাকুরি বিধি অনুযায়ী তাদের জৈষ্ঠ্যতা ও সুবিধাসহ পুনর্বহাল করা হবে। শরণার্থি ক্যাম্পে স্থাপিত উচ্চ বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সার্টিফিকেট আনবে তাদের সংশ্লিষ্ট বোর্ডের অধীনে বিশেষ পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। শরণার্থি ক্যাম্পের ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে। শরণার্থি প্রতি পরিবারকে ঘর নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠের পারমিট প্রদান করা হবে।

প্রত্যাবর্তনকারী পরিবারের তরুণ তরুণীদের যোগ্যতা সাপেক্ষে উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় সরকারের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরীতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।ত্রিপুরায় শরণার্থি ক্যাম্পে অবস্থানকালে যেসকল বাংলাদেশী শরণার্থি চাকুরির বয়সসীমা অতিক্রম করেছে তাদের বয়স সীমা শিথিলের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী অপরাধের কারণে শাস্তি ঘোষিত হয়েছে তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা ব্যবস্থা করা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি রেখে বেসামরিক এলাকা থেকে ক্যাম্পসমূহ তুলে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। উপজাতীয় হেডম্যানদের স্ব স্ব পদে পুনর্বহাল করা হবে।

চলবে…

 লেখক: সম্পাদক, পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ ও পার্বত্যনিউজ.কম, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন


পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা

Exit mobile version