টেকনাফে অতিদরিদ্রের কর্মসংস্থান প্রকল্পের শুরুতেই ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি: শিশুশ্রমের অভিযোগ

teknaf pic_(5)20

টেকনাফ প্রতিনিধি:
টেকনাফে অতিদরিদ্রের কর্মসংস্থান প্রকল্পে লুটপাটের মহোৎসব চলছে। কাগজে কলমে গত ৩ মে থেকে ৪৪টি প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে হাতে গোনা কয়েকটি প্রকল্পে অপর্যাপ্ত শ্রমিক দিয়ে নামমাত্র কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। কাজে নিয়োজিত এইসব শ্রমিকরা আবার অতিদরিদ্র হিসাবে তালিকাভূক্ত নেই, সাথে রয়েছে শিশু শ্রমিক, নেই তাদের কোন ব্যাংক একাউন্ট, প্রকল্প এলাকায় দেওয়া হয়নি কোন সাইনবোর্ড।

এভাবে কর্মসৃজন প্রকল্পের নামে প্রতিবারের ন্যায় অতিদরিদ্রের জন্য বরাদ্দকৃত কোটি টাকা ভাগ ভাটোয়ারার আয়োজন চুড়ান্ত করেছে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ট্যাগ অফিসারসহ সংশ্লিষ্টরা। ১৮ মে রবিবার দিনবর টেকনাফ সদর ইউনিয়ন ও সাবরাং ইউনিয়নের বেশকটি প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শনে ও বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে কাজের খোঁজ খবর নিয়ে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের অধীনে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের অতিদরিদ্রের কর্মসংস্থান কর্মসূচীর ২য় পর্যায়ে টেকনাফে ৪৬১১ জন শ্রমিকের বিপরীতে ৩ কোটি ৬৮ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা ও নন ওয়েস্ট খাতে ৪১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ প্রদান করে।

এতে ইউনিয়ন অনুযায়ী প্রকল্প, শ্রমিক সংখ্যা, বরাদ্দ ও ট্যাগ অফিসারগণ হচ্ছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়ন প্রকল্প-৮টি, শ্রমিক সংখ্যা ১২০০, বরাদ্দ ৯৬ লক্ষ টাকা, ট্যাগ অফিসার মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মোঃ আলমগীর কবির, সাবরাং ইউনিয়নে প্রকল্প-৯টি, শ্রমিক সংখ্যা ১০০০, বরাদ্দ ৮০ লক্ষ টাকা, ট্যাগ অফিসার যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ মামুন, হ্নীলা ইউনিয়নে প্রকল্প-৮টি, শ্রমিক সংখ্যা ৮০০, বরাদ্দ ৬৪ লক্ষ টাকা, ট্যাগ অফিসার মৎস্য কর্মকর্তা সৈয়দ হুমায়ুন মোর্শেদ, হোয়াইক্যং ইউনিয়নে প্রকল্প-৯টি, শ্রমিক সংখ্যা ৭০০, বরাদ্দ ৫৬ লক্ষ টাকা, ট্যাগ অফিসার সমবায় কর্মকর্তা মোঃ কবির হোসেন, বাহারছড়া ইউনিয়নে প্রকল্প ৯টি, শ্রমিক সংখ্যা ৬০০, বরাদ্দ ৪৮ লক্ষ টাকা, ট্যাগ অফিসার কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ, সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে প্রকল্প ১টি, শ্রমিক সংখ্যা ৩১১ জন, বরাদ্দ ২৪ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা, ট্যাগ অফিসার এআরডি কর্মকর্তা শরীফুজ্জামান।

সরেজমিন পরিদর্শনে রবিবার  টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ডেইল পাড়া এলাকায় শৈলবালা শীলের বাড়ি হতে পশ্চিম দিকে আব্দুর রহমানের খামার বাড়ি সংলগ্ন কচুবনিয়া মেইনরোড পর্যন্ত সড়ক সংস্কার কাজে ২৫০ জন শ্রমিকের স্থলে ২৩ জন শ্রমিক কাজ করছিল। তাও আবার ৪ জন শিশু শ্রমিক দিয়ে এখানে কাজ করানো হচ্ছিল। এতে দেখা যায়, সড়কটিতে ৫০ ফুটের মতো মাটি দেওয়া হয়েছে। ৩ তারিখ থেকে কাজ করে এখনও এতো সামান্য কাজ কেন এ প্রশ্ন করলে শ্রমিক মাঝি পূর্ব গোদারবিল এলাকার আবুল খায়ের জানায়, তারা ১৮ তারিখ থেকে উক্ত কাজে হাত দিয়েছে।

এলাকাবাসীর সাথে কথা বলেও এর সত্যতা জানা গেল।  জানা গেছে ৩ তারিখ থেকে কাজ শুরু হলেও ১৮ মে এই কাজটিতে হাত দেওয়া হয়। অর্থাৎ ১৩ কর্মদিবস পেরিয়ে গেলেও এই প্রকল্পটিতে এক কোদাল মাটিও দেওয়া হয় নাই। কাগজে কলমে কাজ দেখিয়ে পরবর্তীতে ২৫০ জন শ্রমিকের মজুরী উত্তোলন করা হবে এই প্রকল্পটিতে।

এই প্রকল্পটির সাথে আরও একটি কাজ জুড়ে দেওয়া হলেও পশ্চিম গোদারবিল সিরাজ উকিলের বাড়ি হতে পূর্বদিকে সত্তার মেম্বারের গোদা পর্যন্ত খাল পুনঃ খনন প্রকল্পটিতেও এসময় কোন শ্রমিক কর্মরত ছিলনা। এব্যাপারে প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেম্বার আবু সৈয়দের কাছে এতোদিন কাজ হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, শ্রমিকরা এতোদিন প্রকল্পের অন্য একটি কাজে থাকায় ডেইল পাড়ার অংশের কাজে হাত দেওয়া হয়নি।

এব্যাপারে ট্যাগ অফিসার আলমগীর কবিরকে প্রকল্প স্থল থেকে ফোনে অপর্যাপ্ত শ্রমিক ও ১৮ তারিখ থেকে প্রকল্প শুরুর কথা জানালে তিনি কাগজে কলমে ৩ তারিখ থেকে কাজ শুরু হলেও বাস্তবে অনেক দেরীতে কাজ শুরু হওয়ার কথা স্বীকার করেন।  

পরবর্তীতে সাবরাং ইউনিয়নের মোঃ ইউনুচ মেম্বারের প্রকল্পের দুটি অংশের মধ্যে কুরাবুইজ্যাপাড়া মমতাজ বলির বাড়ি হতে পশ্চিম দিকে সীবীচ পর্যন্ত মাটি দ্বারা সড়ক সংস্কার কাজে ৩০ নারী পুরুষকে কাজ করতে দেখা গেলেও প্রকল্পের অন্য অংশে কোন শ্রমিক ছিলনা। এখানে ১০০ শ্রমিকের কাজের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।
সাবরাং ইউনিয়নের শামসুল হক মেম্বারের অধীনে কচুবনিয়া স্লুইস গেইট থেকে কাটাবুনিয়া উত্তর মাথা পর্যন্ত বেড়ীবাঁধ মেরামত কাজে কোন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে কয়েকদিন পূর্বে ৫/৬ জন লোক দিয়ে মেম্বার ১ দিন মাত্র বেড়ী বাঁধে কাজ করেছেন। এখানে ১০০ শ্রমিকের কাজ করার কথা ছিল। একই সময়ে এই প্রকল্পের অন্য দুটি অংশেও কোন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে শামসুল হক মেম্বারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কাজ না করার কথা স্বীকার করে জানান, জোয়ারের কারনে তিনি সেখানে শ্রমিক নিয়োজিত করতে পারেননি ভাটার সময় তিনি কাজ শুরু করবেন বলে জানান।

এব্যাপারে সাবরাং ট্যাগ অফিসার মোঃ মামুনের মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে ইজিপিপি সুপার ভাইজার মোঃ শাহীন হায়দারের কাছে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি জানান, তার পক্ষে সবগুলো প্রকল্প তদারকি করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাই ফাঁকি ঝুকি চলছে বলে তিনি স্বীকার করেন। এসময় তিনি শাহপরীরদ্বীপে অন্য একটি প্রকল্প পরিদর্শনে ছিলেন বলে জানান। এছাড়া কর্মসৃজন প্রকল্পে এখনও কোন টাকা ছাড় করা হয়নি বলেও তিনি জানান।

এ এলাকার বাসিন্দা মৌলভী মনির ও সাবেক ছাত্রনেতা আবুল কালাম জানান, গ্রামের পশ্চিমে বেড়ীবাঁধে ব্যাপক ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসৃজন প্রকল্পের যথাযথ কাজ করা না হলে সামনের বর্ষায় বেড়ীবাঁধ ভেঙ্গে শাহপরীরদ্বীপের মতো হবে বলে আশংকা করছেন এলাকাবাসী।

এভাবে সদর ইউনিয়নের মৌলভী পাড়ায় জামে মসজিদের পুকুর সংস্কার কাজে ১০০ শ্রমিকের স্থলে ১৭ জন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। এলাকাবাসী এবং শ্রমিকরা নিজেরা স্বীকার করেছেন তারা ১৮ মে থেকে উক্ত পুকুর সংস্কার কাজ শুরু করেছেন। এছাড়া উক্ত শ্রমিকরা স্বীকার করেছেন তাদেরকে দৈনিক ভিত্তিতে কাজে নেওয়া হয়েছে এবং ব্যাংকে তাদের কোন একাউন্ট নেই।
এভাবে শত অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে প্রতিবছর উপজেলায় কোটি কোটি টাকার কর্মসৃজন প্রকল্প কাগজে কলমে দেখিয়ে লুপাট করছে সংশ্লিষ্টরা।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারন সম্পাদক নুরুল বশর জানান, সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে অতিদরিদ্রের জন্য সহায়তামূলক এ কর্মসংস্থান প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কিছু জনপ্রতিনিধির কারনে সরকারের সে মহৎ উদ্দেশ্য বারবার নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। যাদের জন্য এ প্রকল্প সেই অতিদরিদ্ররা এ প্রকল্পের টাকা পাচ্ছেন না বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি আরো জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে দলীয় লোকজনের মাধ্যমে তিনি জানতে পেরেছেন ১৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও অনেক স্থানে এখনও কাজই শুরু করা হয়নি অথচ কাগজে কলমে ৩ মে থেকে কাজ চলছে।

এব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন মহলের নজরদারী অতিজরুরী বলে মনে করছেন তিনি। প্রকল্পের অনিয়মের ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা কর্মসংস্থান প্রকল্পের সভাপতি শাহ মোজাহিদ উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, কর্মসংস্থান প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠু ও নিয়ম মাফিকভাবে সম্পাদনের জন্য ট্যাগ অফিসারদের তদারকির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এরপরও যদি কোন প্রকল্পের কাজে অনিয়ম দেখা যায় সেটা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানান তিনি।  

এদিকে ১৯ মে বিকালে উপজেলা মিলনায়তনে কর্মসংস্থান প্রকল্পে নিয়োজিত ইউপি সদস্য ও ট্যাগ অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে কাজের অগ্রগতি বিষয়ে স্থানীয় সাংসদ আব্দুর রহমান বদির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, ইউএনও শাহ মোজাহিদ উদ্দিনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মোঃ জহিরুল ইসলাম জানান, সভায় সঠিকভাবে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।  

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: টেকনাফ, টেকনাফে অনিয়ম দুর্নীতি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন