ডেঙ্গু জ্বর: কী করবেন, কী করবেন না

fec-image

রাজধানী ঢাকাসহ এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু জ্বর। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ে মানুষ রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছে। তবে বারবারই বলা হচ্ছে, এবার ডেঙ্গু ভাইরাস তার ধরন পরিবর্তন করে আক্রমণ করছে। এই ভাইরাস নিয়ে বড় ধরণের গবেষণার প্রস্তুতিও চলছে। তবে যে কথাটি আমরা এই হৈচৈ-এর মাঝে ভুলে যাচ্ছি তা হলো— এখন যারা ডেঙ্গু জরে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয় বা তৃতীয় দফায় আক্রান্ত ব্যক্তি। এ কারণেই এবারে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো প্রায়ই আমাদের কাছে আগের তুলনায় ভিন্ন মনে হচ্ছে।

তবে যতই রূপ পরিবর্তন হোক না কেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পদ্ধতিতে নতুন কোনো পরিবর্তন আসেনি। ডেঙ্গু জ্বরের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। অর্থাৎ এমন কোনো ওষুধ নেই যেটা খেলে আপনার ডেঙ্গু জ্বর ভালো হয়ে যাবে বা ডেঙ্গু জ্বরের মারাত্মক লক্ষণগুলো আর দেখা দেবে না। ফলে এখনো আমরা ডেঙ্গু জ্বরকে এর লক্ষণের ভিত্তিতেই চিকিৎসা দিচ্ছি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসায় গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতায় ডেঙ্গু জ্বর চিকিৎসার সর্বশেষ জাতীয় নির্দেশিকায় (ন্যাশনাল গাইডলাইন) বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে আছে— ডেঙ্গু জ্বরের নতুন শ্রেণিবিন্যাস, তিনটি গ্রুপে চিকিৎসা পদ্ধতি, প্লেটেলেট ও রক্তের ব্যবহার সীমিত রাখা প্রভৃতি। অথচ প্রতিদিনই রক্তের জন্য, প্লেটেলেটের জন্য আমরা চারদিকে হাহাকার দেখছি। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত খুব কম রোগীর জন্যই রক্ত বা প্লেটেলেট লাগবে। না বুঝে, না জেনে ও অপ্রয়োজনে প্লেটেলেট বা রক্ত দিলে রোগীর শরীরে অতিরিক্ত পানি জমে (ফ্লুইড ওভারলোড) মারাত্মক প্রাণঘাতী জটিলতা দেখা দিতে পারে।

আমাদের এখন পর্যন্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, প্লেটেলেট কাউন্ট ৭ হাজার থেকে ৪ হাজারে নেমে যাওয়ার পরেও কোনো কোনো রোগীকে রক্ত বা প্লেটেলেট দিতে হয়নি। তাই প্লেটলেট কমতে শুরু করলেই যে রক্ত বা প্লেটলেট দিতেই হবে, সে বিষয়ে চূড়ান্তভাবে কিছু বলা যাবে না। চিকিৎসকই রোগীর যাবতীয় লক্ষণ ও শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

তাই বলে ডেঙ্গুকে হালকাভাবে নেওয়ার কিন্তু কোনো সুযোগ নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাত্র এক বা দুইদিনের জ্বরেই মারাত্মক সব জটিলতা পাওয়া যাচ্ছে, যার নাম ‘ডেঙ্গু এক্সপানডেড সিনড্রোম’। আর তাই এসময়ে কারো জ্বর এলে কিছুতেই অবহেলা করা যাবে না। চলুন প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জেনে নিই— ডেঙ্গু মৌসুমে জ্বর এলে আপনি কী করবেন?

প্রশ্ন ১: আমার জ্বর ১ থেকে ৪ দিনের। সাথে শরীর, মাথা আর চোখ ব্যথা আছে। আমি প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, স্যালাইন ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার খাচ্ছি। আমি জ্বর বা ব্যাথার জন্য প্যারাসিটামল অর্থাৎ নাপা/এইস/ফাস্ট/রেনোভা প্রভৃতি নামের ওষুধ ছাড়া আর কোনো ওষুধ খাচ্ছি না। আর কী করব?

উত্তর: অবশ্যই একজন চিকিৎসকের কাছে যাবেন। তিনি আপনার রোগের লক্ষণ অনুযায়ী বিভিন্ন পরীক্ষার সঙ্গে রক্তের Dengue NS1 পরীক্ষা করতে দিতে পারেন। পরীক্ষাগুলো অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে করিয়ে নিন। ‘আগে ওষুধ খেয়ে দেখি’ ধরনের অবহেলা করবেন না।

প্রশ্ন ২: আজ ৫ দিন ধরে জ্বর। কমছেই না। সঙ্গে শরীর, মাথা আর চোখ ব্যথা আছে। কী করব?

উত্তর: জ্বর পঞ্চম দিনে পড়লে Dengue NS1 টেস্ট করে ডেঙ্গু শনাক্ত করা যাবে না। পঞ্চম থেকে সপ্তম দিন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর হলেও ডেঙ্গুর সব টেস্ট নেগেটিভ হতে পারে। তাই এই সময়ে ডেঙ্গুর টেস্ট না করে শুধু CBC পরীক্ষা করে অপেক্ষা করাই ভালো। সপ্তম দিন থেকে অ্যান্টিবডি টেস্ট করা যায়।

প্রশ্ন ৩: আমার রক্ত পরীক্ষা করেছি। ডেঙ্গু টেস্ট নেগেটিভ এসেছে। আমার তো ডেঙ্গু জ্বর হয়নি। আমি কি তাহলে শঙ্কামুক্ত?

উত্তর: এবার যেটা দেখা যাচ্ছে তা হলো— NS1 টেস্টে নেগেটিভ রেজাল্ট এলেও ডেঙ্গু জ্বর হতে পারে। তাই আপনাকে জ্বর থাকা অবস্থায় স্যালাইন, শরবত খেয়ে যেতে হবে এবং জ্বর যেদিন কমে যাবে সেদিন আবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দেখিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে আবার CBC, অ্যান্টিবডি পরীক্ষাও করাতে হবে।

প্রশ্ন ৪: আমার রক্ত পরীক্ষা করিয়েছি। ডেঙ্গু টেস্ট পজিটিভ এসেছে। এখন কী হবে?

উত্তর: বিচলিত হবেন না। যতক্ষণ জ্বর আছে ততক্ষণ আপনার ঝুঁকি কম। বেশি বেশি করে তরল খান। প্যারাসিটামল ছাড়া ও চিকিৎসকের নির্দেশনা ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ খাবেন না। নিয়মিত জ্বর মাপুন। শরীরে কোনো জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন ৫: জ্বর থাকা অবস্থায় কোন কোন জটিলতা দেখা দিলে আমি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যাব?

উত্তর: ক্রমাগত বমি, প্রচণ্ড পেট ব্যাথা, অতিরিক্ত শারীরিক দুর্বলতা, যেকোনো ধরনের রক্তপাত, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, মাথা ঘুরানো, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, শ্বাসকষ্ট বা অন্য যেকোনো কারণে শরীরের অবনতি হচ্ছে বলে মনে হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

প্রশ্ন ৬: আজ আমার জ্বর কমে গেছে। আমি কি এখন নিরাপদ?

উত্তর: না, জ্বর কমার পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে (ক্রিটিক্যাল ফেজ)। এসময় আপনাকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ, এসময় রক্তনালী ও রক্তে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হবে যা খুব সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

এসময় অবশ্যই একবার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। হাসপাতালে ভর্তি থেকে স্যালাইন নেওয়ার দরকার পড়তে পারে। প্রতিদিন অন্তত একবার রক্তের CBC পরীক্ষা করাতে হবে। নিয়মিত ব্লাড প্রেশার দেখতে হতে পারে। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, স্যালাইন ও অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার খেতে থাকুন।

প্রশ্ন৭: আমি রক্ত পরীক্ষা করেছি। আমার রক্তে প্লেটলেট অনেক কম। আমি এখন কী করব?

উত্তর: শরীরে কোনো বিপদচিহ্ন (উপরে উল্লেখিত) বা রক্তক্ষরণের চিহ্ন থাকলে চিকিৎসককে জানান। রক্তক্ষরণের চিহ্ন হলো— চামড়ায় লাল বা কালো দাগ; দাঁতের মাড়ি থেকে ও প্রস্রাব-পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত, মাসিক চলা অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ; কালো রঙের নরম বা পাতলা পায়খানা প্রভৃতি। যদি কিছু না ও থাকে, তাহলেও এসব লক্ষণ নিয়ে সচেতন থাকুন। অস্বাভাবিক কোনো কিছু হলে চিকিৎসককে দ্রুত জানান। প্লেটলেট কাউন্ট এক লাখের নিচে নেমে এলে আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

প্রশ্ন ৮: আমার রক্তে প্লেটলেট এত কম, অথচ আমাকে প্লেটলেট বা রক্ত দিতে হবে না?

উত্তর: দিতেই হবে, এমন নয়। দুয়েকটি বিশেষ কারণ না ঘটলে আপনাকে রক্ত বা প্লেটলেট কিছুই দিতে হবে না। বিশেষ কারণগুলো আপনার চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।

প্রশ্ন ৯: আমার বাবা/মা/আত্মীয়ের ডেঙ্গু হয়েছিল। তখন তাকে ২/৩/১০ ব্যাগ প্লেটলেট/রক্ত দিতে হয়েছিল। আর এখন বলছেন প্লাটিলেট দেওয়া লাগবে না!

উত্তর: না, লাগবে না। এমনকি আপনি যদি মুখে স্যালাইন, শরবত, ডাবের পানি প্রভৃতি তরল পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারেন, তাহলে আপনাকে শিরাপথে খুব বেশি স্যালাইন দেওেয়ারও প্রয়োজন নেই। তবে আপনাকে চিকিৎসকের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করতে হবে এবং ব্লাড প্রেশার বা রক্তচাপ মনিটরিংয়ে রাখতে হবে।

প্রশ্ন ১০: কীভাবে বুঝব আমার সঠিক চিকিৎসা হচ্ছে কি না?

উত্তর: বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক ডেঙ্গু জ্বর চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশনা বা ন্যাশনাল গাইডলাইন রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কেবল প্লেটেলেট কমে যাওয়ার জন্য আপনাকে প্লেটলেট বা রক্ত দিতে হবে না। আপনাকে জ্বর কমে যাওয়া পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে স্যালাইন খেতে হবে ও শিরাপথে স্যালাইন দিতে হতে পারে।

নিয়মিত ব্লাড প্রেশার মাপতে হবে এবং প্রতিদিন CBC পরীক্ষা করতে হবে। (শুধুমাত্র প্লেটেলেট কাউন্ট বা হেমাটোক্রিট দেখলে চলবে না)। যেকোনো হাসপাতালে ভর্তি হলে ওপরের নিয়মগুলো অনুসরণ করতে চিকিৎসককে অনুরোধ করুন।

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চেষ্টা করুন। সেখানে মেঝেতে থাকতে দিলেও আপনি সঠিক চিকিৎসা পাবেন।

চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ, আমরা সবাই যেন ২০১৮ সালের ডেঙ্গু েজ্বরের ন্যাশনাল গাইডলাইন এবং নতুন ২০১৯ সালের পকেট গাইডলাইন অনুসরণ করি। গাইডলাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো যেন বারবার পড়ি এবং স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল মেনে চলি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওয়েবসাইটে গেলেই আপনি নতুন গাইডলাইন পেয়ে যাবেন।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ

ডেঙ্গু জ্বর থেকে বাঁচার প্রধান উপায় ডেঙ্গু মশার জন্ম রোধ করা। ডেঙ্গু ভাইরাস কিন্তু মশার ডিমের মাধ্যমে পরবর্তী মশক প্রজন্মে পরিবাহিত হয়। তাই ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধই ডেঙ্গু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আর সেটার জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি আমাদের সদিচ্ছারও প্রয়োজন আছে। আমাদের নিজ উদ্যোগে নিজেদের বাসগৃহ ও কর্মস্থল, বাড়ি ও অফিসের ছাদে, কার্নিশে, পার্কিংয়ে এবং অন্যান্য সন্দেহজনক স্থানে পরিষ্কার পানি জমতে দেওয়া রোধ করব।

সিঙ্গাপুর সরকার ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধে হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন বাসাবাড়ি, অফিসে হানা দেয়, খুঁজে দেখে কোথাও জমানো পানি আছে কি না। জমানো পানি খুঁজে পাওয়া গেলে বড় অঙ্কের অর্থদণ্ড দিতে হয়। তাই দেশটিতে প্রতিটি নাগরিক নিজ গরজেই নিজেদের বাসা-অফিসে পানি জমতে দেয় না। বাকি কাজটুকু সরকার করে। আমাদের নিজেদের এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে, এডিস তথা ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধে ও মশা নিধনে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা নিজেরা কী করছি। ডেঙ্গুর কিন্তু কোনো জাতপাত ভেদাভেদ নেই। তাই নিজেদের প্রয়োজনেই নিজেদেরই সতর্ক হতে হবে।

সূত্র: সারা বাংলা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন