তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের “অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ” সম্প্রসারণ প্রস্তাব মন্ত্রিসভার অনুমোদন

image_81106_0

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকার বড় করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো ১ চেয়ারম্যানসহ ৪ সদস্য নিয়ে গঠিত। অন্তর্বর্তী পরিষদের আকার বড় করার পর ৫ জনের জায়গায় ১১ জন নিয়ে পরিষদ গঠন হবে। এই ১১ জনের মধ্যে ১ জন চেয়ারম্যান ও ১০ জন সদস্য থাকবেন। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় এ পরিষদ বলবৎ হবে।

সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভুইয়া সাংবাদিকদের এ কথা জানান। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতিত্ব করেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসেইন ভুইয়া বলেন, ‘রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন আইন, ২০১৪ ) এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন আইন, ২০১৪ ) এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন আইন,২০১৪ ) এর খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।

মন্ত্রিপরিষদের সচিব জানান, তিনটি পার্বত্য জেলার জন্য তিনটি জেলা পরিষদ আছে। জেলা পরিষদ আইনে আছে, ১ জন চেয়ারম্যান, ২০ জন উপজাতীয়, ১০ জন অ-উপজাতীয় এবং তিন জন মহিলা নিয়ে মোট ৩৪ সদস্যের পাবর্ত্য জেলা পরিষদ গঠিত হবে এবং তারা প্রত্যেকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। কিন্তু যদি নির্বাচন না হয় তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে পারবে।’

বর্তমানে এই তিন পার্বত্য জেলায় অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ আছে। চেয়ারম্যানসহ মোট পাঁচ জন সদস্য নিয়ে এ জেলা পরিষদ। মন্ত্রিপরিষদ মনে করছে, অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ যদি বড় করা হয়, তাহলে সকল নৃগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ থাকবে। এ প্রেক্ষাপটে পাঁচ সদস্যের জায়গায় ১১ সদস্য অনুমোদন করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ১১ জন সদস্যের মধ্যে এক জন চেয়ারম্যান ও বাকি  ১০ জনের মধ্যে সাত জন নৃগোষ্ঠী এবং  তিন জন অ-নৃগোষ্ঠী। রাঙ্গামাটি জেলায় এর মধ্যে চাকমা ৩ জন, মারমা, খিয়াং, লুসাই এবং ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী থেকে এক জন। খাগড়াছড়িতে চাকমা তিন জন, মারমা ও ত্রিপুরা থেকে দুই জন। বান্দরবান জেলায় মারমা তঞ্চঙ্গা, চাকমা, মুরং, লুসাই, খুমি, ইত্যাদি জনগোষ্ঠী থেকে সাত জন নেয়া হবে।

অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় হতে সম্প্রতি তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের “অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ” সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সদস্য সংখ্যা ০৪(চার)জনের স্থলে ১০(দশ)জন করা হয়েছে। তবে, সদস্যগণের সংখ্যা হবে সম্প্রদায়ভিত্তিক। যা, আজ সোমবার ১০ মার্চ,২০১৪খ্রি. তারিখে মন্ত্রিসভার অনুমোদিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে রাংগামাটি,খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার জন্য তিনটি আইন (যথাক্রমে ১৯,২০ ও ২১নং আইন) জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাশের পর ১ম বারের জন্য তিন পার্বত্য জেলা (স্থানীয় সরকার) পরিষদ নির্বাচন হলেও পরবর্তীতে আর কোন নির্বাচন হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন বিভিন্ন সময়ে ছোট-খাট সংশোধন করা হলেও ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সাথে সম্পাদিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তিচুক্তি) পরবর্তী ১৯৯৮ সালে উল্লিখিত আইনসমূহ বড়ধরনের সংশোধন করা হয়।

উক্ত সংশোধনের ফলে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে অধিকতর শক্তিশালী করা হয় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব/ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়। তবে, ১৯৯৭ সালে আইনগত জটিলতার মুখে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন করা সম্ভব না হওয়ার প্রেক্ষিতে “অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ” গঠনের পদ্ধতি সন্নিবেশ করে আইন সংশোধন করা হয়। উক্ত সংশোধিত আইনে ১৬(ক) ধারা সনিড়ববেশ করতঃ উপধারা-২ অনুযায়ী সরকার একজন চেয়ারম্যান এবং চারজন সদস্য সমন্বয়ে “অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ” গঠন করিবে-মর্মে বিধান করা হয়। উক্ত সংশোধিত আইন অনুযায়ী তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে,যে সরকার আসে-সে সরকার কর্তৃক দলীয় বিবেচনায় নির্বাচিত লোকদেরকে চেয়ারম্যান ও সদস্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। “অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ” গঠনের মাধ্যমে চলতে থাকে ১৫/১৬ বছর।

সূত্র মতে, রাংগামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ০৫জনের “অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদ” থাকলেও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় দীর্ঘ কয়েক বছর (আইনগত জটিলতা মীমাংসিত হলেও) চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়নি। ফলে, নিয়োগকৃত ০৪ জন সদস্যদের মধ্য হতে ০১জন সদস্য (বাবু কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা) অস্থায়ী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি, উক্ত অস্থায়ী চেয়ারম্যান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার প্রেক্ষিতে অপর ০৩ সদস্য হতে ০১জন উপজাতীয় সদস্য (বাবু চাইথোঅং মারমা)অস্থায়ী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি স্ব স্ব জেলার বসবাসরত সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি এবং অউপজাতীয় জনগোষ্টির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত
করা এবং জেলা পরিষদের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে আইনের ১৬(ক) ধারার উপ-ধারা (২) সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আইন সংশোধনের যৌক্তিকতা হিসেবে আরও উলে−খ করা হয় যে, বর্তমানে পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যক্রম বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ০৫ জনের অন্তর্বতীকালীন পরিষদ দিয়ে এ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব নহে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী উক্ত ধারায় ০৪ জন সদস্যের স্থলে ১০ জন করা হবে এবং উল্লিখিত ১০ জন কোন কোন নৃ-গোষ্ঠী থেকে তা সুষ্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। জেলাভিত্তিক নৃ-গোষ্টি এবং অউপজাতীয় সম্প্রদায়ের সদস্য সংখ্যা এবং মুল আইনের সদস্য সংখ্যা সম্পর্কিত তুলনামূলক বিশ্লেষণ নিম্নরূপঃ

(ক) রাংগামাটি পার্বত্য জেলায় চাকমা সম্প্রদায় হতে ৩ জন,মারমা সম্প্রদায় হতে ১জন,খেয়াং ও লুসাই হতে ১জন, তংচংগ্যা হতে ১জন, ত্রিপুরা হতে ১জন এবং অউপজাতীয় হতে ৩জন প্রস্তাব করা হয়। (যেখানে মুল আইন ৩০জন সদস্যদের ক্ষেত্রে চাকমা ১০জন, মারমা ৪জন, খেয়াং ও লুসাই-২জন,তংচংগ্যা ২জন, ত্রিপুরা ১জন এবং অউপজাতীয় ১০জন উল্লেখ আছে)। এখানে অন্যান্য নৃ-গোষ্টিসহ অউপজাতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব কম ধরা হলেও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

(খ) খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় চাকমা সম্প্রদায় হতে ৩জন, মারমা হতে ২জন,ত্রিপুরা হতে ২জন এবং অউপজাতীয় হতে ৩জন প্রস্তাব করা হয়। (যেখানে মুল আইন ৩০জন সদস্যদের ক্ষেত্রে চাকমা ৯জন, মারমা ৬জন, ত্রিপুরা ৬জন এবং অউপজাতীয় হতে ৯জন উল্লেখ আছে)। এখানে অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী না থাকায় তেমন আলোচনার সুযোগ নেই। তবে, পার্বত্য জেলা পরিষদের শুরু হতে অউপজাতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব জনসংখ্যার বিভাজন অনুযায়ী কম রয়েছে।

(গ) বান্দরবান পার্বত্য জেলায় মারমা সম্প্রদায় হতে ২জন, তংচংগ্যা ও চাকমা সম্প্রদায় হতে ১জন, ম্রো(মুরং) হতে ১জন, ত্রিপুরা হতে ১জন, চাক+খেয়াং+খুমী হতে ১জন,বোম+লুসাই+পাংখু হতে ১জন এবং অউপজাতীয় হতে ৩জন প্রস্তাব করা হয়। (যেখানে মুল আইন ৩০জন সদস্যদের ক্ষেত্রে মারমা ১০জন, তংচংগ্যা ও চাকমা ২জন, ম্রো(মুরং) হতে ৩জন, ত্রিপুরা+উচাই হতে ১জন,চাক+খুমী হতে ২জন, বোম+লুসাই+পাংখু হতে ১জন এবং অউপজাতীয় ১১জন উলে−খ আছে)।
এখানে মারমা সহ অন্যান্য নৃ-গোষ্টি এবং অউপজাতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব কম ধরা হলেও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।
 সূত্র জানিয়েছে, পার্বত্য জেলার গুরুত্বপূর্ণ আইন সংশোধনের পূর্বে জনমত যাচাই কিংবা সংশ্লিষ্ট কোন বিভাগ/দপ্তর বা জনপ্রতিনিধি হতে কোন মতামত নেয়া হয়নি। শুধুমাত্র কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছা/অভিসন্ধির কারণে পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে,পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোকে দলীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত না করে, জেলা পরিষদসমুহের অনতিবিলম্বে নির্বাচন দেয়া দরকার।মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ব্যাক্তিগত আগ্রহে এই বিল পাশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনাদিকে প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনে সদস্য সংখ্যা বিভাজনে কিছুটা বিতর্কতো রয়েছেই। এখানে উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ৪(চার)জন সদস্যই সরকার ইচ্ছামতো যেকোন সম্প্রদায়ের নিয়োগ করতে পারলেও বর্তমানে ১০(দশ)জন সম্প্রদায়ভিত্তিক করার কারণে সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন করার জন্য কোন আইনের সংশোধনী আনা প্রয়োজন হয়, সেই ব্যবস্থা নেয়াই আশু প্রয়োজন।

পার্বত্য জেলায় আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজাতীয়দের জন্য সংরক্ষিত। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইনের মাধ্যমে বোর্ডের চেয়ারম্যানও উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার দেয়ার বিধান করা হচ্ছে। অউপজাতীয়দের জন্য কোন পদ সংরক্ষণ কিংবা অগ্রাধিকারের কোন বিধান কোন আইনে নেই। তাই, সরকারের উচিত পার্বত্য জেলার সকল আইন পুনর্বিবিচেনা করে অউপজাতীয় সম্প্রদায়ের জন্য কিছুটা হলেও সুযোগ সৃষ্টি করা একান্ত প্রয়োজন।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী বাঙালী সংখ্যা প্রায় সমান হলেও পরিষদে বাঙালীর সংখ্যা উপজাতীয়দেয় অর্ধেক করায় বাঙালী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিল নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাছাড়া এই জাতিগত সদস্যপদ নির্ধারণ করা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল নীতি ও মৌলিক অধিকারের ১৯, ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদের সরাসরি পরিপন্থী বলে বিশেষজ্ঞগণ অভিমত প্রদান করেছেন। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এ ধরণের বিশেষ অধিকার সম্বলিত ধারাগুলো শান্তিচুক্তির বৈধতা সংক্রান্ত মামলায় উচ্চ আদালতে অবৈধ ও সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষিত হয়েছে। অন্যদিকে এই ধরণের বিভাজন নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠনের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধক বলে তাদের অভিমত। 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন