ত্রিপুরা সংস্কৃতিতে বহু আকর্ষণীয় নৃত্য প্রচলিত রয়েছে

http://parbattanews.com/wp-content/uploads/2013/06/tribal-logo.jpg

 

ভূপ্রকৃতি,জলবায়ু, জীববৈচিত্রের মতোই জনবৈচিত্রে সমৃদ্ধ আমাদের এই বাংলাদেশ। বাঙালী এখানকার প্রধান নৃগোষ্ঠী হলেও বেশ কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস রয়েছে সমগ্র বাংলাদেশ ছড়িয়ে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে সবচেয়ে বেশী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চল। এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সভ্যতাকে করেছে সমৃদ্ধ। জনসমষ্টিতে এনেছে বৈচিত্র। কিন্তু তাদের সম্পর্কে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধারণা অতি অল্পই। পার্বত্য নিউজ ডটকম ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর পরিচিতি দেশবিদেশের পাঠকদের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছে। আজ প্রকাশিত হলো ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী নিয়ে। প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন- ফারজানা শারমিন

ত্রিপুরা

ত্রিপুরা নামটি তোয়প্রা  থেকে এসেছে। তোয় মানে পানি বা নদী আর প্রা মানে সঙ্গমস্থল বা মোহনা । বাংলাদেশের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বেশীরভাগ মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে।  এছাড়া রাজবাড়ি, চাদঁপুর, ফরিদপুর,কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চলে ও তারা বসবাস করে । ত্রিপুরা সমাজ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। ত্রিপুরা জাতি ৩৬টি গোত্রে বিভক্ত। এই সমাজে শিশু জন্মালে শুমাচৗক (দাত্রী ) , অচাই (পুরোহিত)  উভয়কে মিলে পূজা দিতে হয়। হলুদ ,সুকই বমলক ও পানি মিশিয়ে কউমা বৗতৈ তৈরি করতে হয়। সে কউমা বৗতৈ বাশেঁর চুঙায়  করে বাড়ি নিয়ে যেতে হয়।  পূজা দেওয়ার পরে সেই বাশেঁর চুঙায় কউমা বৗতৈ এর সাথে পূজায় বলি দেওয়া মুরগীর রক্ত মেশাতে হয়।শরীর থেকে নাঁভি পৃথক হবার পর মুরগী কেটে নদী বা ছড়ায় গিয়ে পূজা দিতে হয়। আরেকটি বড় অনুষ্ঠান আবিয়াক সুনায় পান্ডা বা নামকরণ অনুষ্ঠান । এই অনুষ্ঠানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যারা নবশিশুর নাম দিতে চায় তারা সবাই একেকটি নাম প্রস্তাব রেখে প্রদীপ  জালিয়ে নামকরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে। যে ব্যাক্তির প্রদীপ শেষ  র্পযন্ত জ্বলতে থাকবে শিশুটির নাম  তার প্রস্তাবিত নামানুসারে চুড়ান্ত করা হবে। 

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী মুলত  সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী । তবে বর্তমানে বান্দরবান জেলার অধিকাংশ ত্রিপুরাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী।  ত্রিপুরা রমণীরা  রিনাই,রিসা ও কুবাই নামক পোশাক পরে ।  কুবাই  ও রিসা পরা হয় কোমরের উপরের অংশ আবরণের জন্য। রিনাই পরা হয় কোমর থেকে নিচের অংশ আবরণের জন্য। অনেক সময় রিসা বক্ষবন্ধনের জন্য, মাথায় পাগড়ির মত করেও ব্যবহার করা হয় ।  অতীতে ত্রিপুরা পুরুষরা ঘরের তৈরি গামছা ও কুবাই বা শার্ট পরত। বর্তমানে ত্রিপুরা পুরুষরা  আধুনিক পোশাক পরে। মহিলাদের পোষাকে ও বৈচিত্র্যিতা এসেছে ।এছাড়া ত্রিপুরা মহিলারা সাংগে, আচিলি, বাংগ্রি, বা বালা কুচি, তয়ার মত চোখ ধাধাঁনো  অলংকার ব্যবহার  করে।  চুলের খোপায় আচিলি, লক,চন্দ্রহারের মত উপকরন ব্যবহার করে।

http://parbattanews.com/wp-content/uploads/2013/06/Pic-3.jpg

ত্রিপুরা সংস্কৃতিতে বহু বৈচিত্র্যময়, আকর্ষনীয় ঐতিহাসিক নৃত্য  প্রথা  চালু   রয়েছে। গয়রা নৃত্যে  জুমচাষ ও ত্রিপুরাদের জীবনজীবিকার ব্যাপারটি মুখ্য। এতে কথামালার সুরে সুরে   নৃত্য পরিবেশন করা হয়।  আরেকটি বিশেষ নৃত্য হল (কাথারক   নৃত্য ) বোতল নৃত্য ।এই নৃত্য  ত্রিপুরাদের  বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়।  এ সময় কাথারক পূজা দিতে হয়। পূজা শেষ হলে বর কনে পক্ষের কেজু কেজা(খুব নিকট আত্মীয়,সহচর ) দুজন ঢোলের তালে তালে মাথায় দীপশিখা সহ বোতল, হাতে থালাসহ পানি ভর্তি কলসির  উপরে উঠে নাচে । তারা বিশ্বাস করে- দীপশিখা জ্ঞানের প্রতীকপানি ভর্তি কলসি  কর্মের প্রতীক, মদভর্তি বোতল শক্তির প্রতীক এবং ফুলের মালা ভক্তির প্রতীক ।

ব্যবহারিক অর্থে ত্রিপুরা  ভাষার নাম ককবরক। কক অর্থ ভাষা এবং বরক অর্থ হল মানুষের ভাষা।  চীনের উত্তর পশ্চিমে ইয়াংসি ও হোয়াংহো নদীর উৎস স্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে এই ভাষার উৎপত্তি।ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা দু ধরনের পদ্ধতিতে ভাত রান্না করে- ১. সুংনায় ২. প্রৈঙনায় পদ্ধতিতে।  প্রৈঙনায় পদ্ধতিতে বাশেঁর চুঙায় ভাত রান্না হয়। এছাড়া তারা  প্রতিদিন রুজাক, গুদাকজাক, চাখৈ, ও সঙজাক তরকারির একাট বা দুটি পদ দিয়ে আহার সারে। তরকারি  রান্নার ক্ষেত্রে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ১২  প্রকারের রন্ধনপ্রনালী ব্যবহার করে ।

ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা গাছের শিকড়, লতাপাতা, ফুলফল, ছাল ইত্যাদি বনজ দ্রব্যের সাহায্যে  চিকিৎসা করে। জন্ডিস রোগের জন্য আমলকি, হরিতকি, বাকালা, চিরতা, পিপলি,তুলসি,অড়হর পাতার রস মধুর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করে। ম্যালেরিয়া  রোগের ক্ষেত্রে ১৫টি তাজা তুলসি পাতার সাথে ১০টি কচিঁ শিউলি পাতা একত্রে বেটে শোধিত রস মধু সহ সেবন করলে  রোগ ভালো হয় বলে তারা বিশ্বাস করে ।।এছাড়া ত্রিপুরারা  যক্ষা, হাড়ভাঙ্গা , বাত ,পেটের ব্যাথাসহ বহু রোগের চিকিৎসা করে থাকে ।ত্রিপুরাদের প্রধান পেশা কৃষি।  শিক্ষিত ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা অনেকে সরকারি, বেসরকারি চাকরি করছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার একেবারে কম। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর তিনভাগের এক ভাগ গ্রামে কোন প্রাইমারী স্কুল নেই। ত্রিপুরাদের ভুমি মালিকানা অলিখিত।

যে ব্যাক্তি কোনো বন পাহাড়কে প্রথম একবার ভোগ দখল করবে সেই জুম ভূমি তার হবে।ত্রিপুরাদের সামাজিক উৎসবের নাম বৈসু, বৈসুমা,বিসিতাকাল ইত্যাদি । উৎসবগুলো  বৈসাবি উৎসবের মতই পালিত হয়, যে উৎসব চাকমা, মারমাসহ বহু উপজাতি একত্রে অথবা আলাদা ,আলাদা ভাবে পালন করে থাকে ।  পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক এবং জাতীয় রাজনীতিতে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী নেতৃস্থানীয় ভুমিকা পালন করছে।ত্রিপুরাদের ৩৬টি গোত্র রয়েছে।  ত্রিপুরা সমাজে নারী সমাজ নানা অবহেলা বৈষম্যের স্বীকার হয়।এই সমাজে চার রকম বিয়ে হয়- ১. হামজাক লাই রামা ২. খকয়ৈই লামা ৩. ফারান খৗলায়ৈ লামা ৪. চামিরি কামা । ত্রিপুরা মৃতদেহকে দাহ করে।  কম বয়সী শিশু,দুরারোগ্য রোগে মৃত্যু বরণকারীদের কবর দেওয়া হয়।  অন্যান্যদেরকে শ্মশানে পোড়ানো হয়।

ছবির ক্যাপশন: কথারক নৃত্য পরিবেশন করছেন ত্রিপুরা তরুণীরা।

  (তথ্যসূত্র- বাংলাদেশের আদিবাসী: এথনোগ্রাফিয় গবেষণা)

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন