দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে সতর্ক দৃষ্টি প্রয়োজন

fec-image

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের সাথে ভারতের মিজোরাম রাজ্য এবং মিয়ানমারের  রাখাইন রাজ্যের সাথে সীমান্ত রয়েছে। এই অংশটি ৩০০ থেকে ৩,০০০ মিটার বা তারও বেশি বিস্তৃত পাহাড়ে আচ্ছাদিত। একই সাথে এই ত্রি দেশীয় সীমান্ত এলাকায় আধুনিক যোগাযোগ সুবিধা নেই বললেই চলে। প্রধানতঃ ঘন বাঁশের বন দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ায় এই এলাকা স্থল এবং আকাশ থেকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এখানকার ভৌগলিক অবস্থা এমন যে, বিদ্রোহীরা খুব দ্রুতই পালিয়ে যেতে পারে- যা নিয়মিত সেনাবাহিনীর জন্য দুঃস্বপ্ন।

এই অঞ্চলে বিদ্রোহী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ, ভারত এবং মিয়ানমার সীমান্ত খুব কমই মান্য করে চলে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে যে এই তিনটি দেশের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন। একটিতে গণতন্ত্র বিদ্যমান। আরেকটি গণতন্ত্রে উত্তোরণের সংগ্রামে রত এবং তৃতীয়টি  সামরিক স্বৈরতন্ত্র। তাই তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যমতে পৌঁছানো চ্যালেঞ্জিং। তবে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির বিষয়টা অন্যরকম। তারা একে অপরের সাথে সহযোগিতা করতে পারে বা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে। এমনকি নিরাপত্তা বাহিনীর চাপের মুখোমুখি হলে দূর্গম সীমান্ত দিয়ে তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পারে।

এই ত্রি-সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের বিক্ষিপ্ত জনবসতি রয়েছে। তাঁরা মূলত জুম চাষের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তাঁরা প্রশাসনের প্রতি উদাসীন কিংবা বিরোধী মনোভাবাপন্ন হয়ে থাকে। ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক তার “ট্রাবলড পেরিফেরি” বইয়ে লিখেছেন, এখানকার অল্পবয়সী ছেলেরা থ্রিজি (Girls, Guns, Guitars) তে নিমগ্ন থাকে। যদিও ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী মিজোরাম এবং ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলির সাথে একটি শান্তি চুক্তি করেছে বলে দাবি করে- তবে তা ততটা কার্যকর নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই রকম। পার্বত্য চট্টগ্রামে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি(পিসিজেএসএস) এর সাথে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশ সরকারের একটি শান্তি চুক্তি হলেও সেখানে এখন পিসিজেএসএস ছাড়াও পিসিজেএসএস (সংস্কারবাদী) এবং ইউপিডিএফ মূল ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে।

মিয়ানমারের চিন ও রাখাইন রাজ্যে চিন ন্যাশনাল আর্মি এবং আরাকান আর্মির মতো গোষ্ঠী রয়েছে। মিয়ানমারেও একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, কিন্তু এখন আরাকান আর্মি উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী এবং একইভাবে জান্তা সরকারের জন্য গুরুতর মাথাব্যথার কারণও। আরাকান আর্মি রাখাইনের বেশিরভাগ অংশে সমান্তরাল প্রশাসন চালায়, যেখানে জান্তা বেশিরভাগ শহর নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে এক পক্ষের সাথে সম্পর্ক অন্য পক্ষের বিরোধিতা করার নামান্তর। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) রাখাইনকে অস্থিতিশীল করে তুলছে বলে জান্তা দাবি করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবসানের প্রশ্নে, মিয়ানমারের রাজ্য প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এবং আরাকান সেনা কমান্ডার মেজর জেনারেল তুন মায়াত নাইং-এর ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। সর্বোপরি আঞ্চলিক শক্তি ও বৈশ্বিক শক্তির ভূরাজনীতি জড়িত। সুতরাং, এই ঘোলাটে পরিস্থিতি বাংলাদেশ কীভাবে মোকাবিলা করবে তা একটি জটিল প্রশ্ন।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে ঐতিহ্যগত হুমকির (প্রকাশ্য সামরিক চ্যালেঞ্জ) সম্ভাবনা কী কী? বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশীর দেশ ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে ভারতের কাছ থেকে প্রথাগত হুমকি নানা কারণে প্রত্যাশিত নয়। যাইহোক, মিয়ানমার জান্তা থেকে প্রথাগত হুমকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জান্তা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে। তাদের যেকোনো সামরিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হবে একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন, এবং মিয়ানমার তার রাজনৈতিক লক্ষ্য বেশ স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করেছে। সুতরাং, মিয়ানমারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী তা চিহ্নিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে আমরা যা দেখছি তা হল, ঝুঁকির একটি জটিল সমন্বয়। বান্দরবান বাংলাদেশের একমাত্র জেলা যেটির দুই দেশের সাথে সীমান্ত রয়েছে। আবার এটি সম্ভবত একমাত্র জেলা যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় পপি এবং গাঁজার মত মাদক চাষ করা হয়। এসব মাদকের ট্রানজিটিং হাব টেকনাফ। এছাড়া সহিংস চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি রয়েছে। এসব অপ্রচলিত নিরাপত্তা সমস্যা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অস্থিতিশীল করতে পারে এবং ঐতিহ্যগত নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পরিণত হতে পারে। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী নিজেরাই অপ্রচলিত নিরাপত্তা হুমকির উৎস।

দক্ষিণ-পূর্বের সুরক্ষিত পরিবেশ থেকে উদ্ভূত বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত এবং অপ্রথাগত হুমকিগুলি বোঝা মোটামুটি সহজ, কারণ বিভিন্ন সংস্থা এসব এড়াতে কমবেশি প্রস্তুতি নিচ্ছে। এটা বলা যেতে পারে যে, এখন যা ঘটছে তার উপর ভিত্তি করে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকা অজানা কোন হুমকির উপর ভিত্তি করে নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা শিবিরে ৪৬০,০০০-এর বেশি শিশু সঠিক শিক্ষা, আশা ও স্বপ্ন ছাড়াই বেড়ে উঠছে। তারা তাদের ছোট জীবনে অকল্পনীয় ভয়াবহতা দেখেছে। ২০১৭ সালে, তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের মাকে সম্ভ্রমহানি হতে দেখেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে, বেশিরভাগই প্রাপ্তবয়স্ক হবে – গৃহহীন তাদের মনে আঘাত এবং অন্তরে থাকবে ঘৃণা । এই সমস্যার সমাধান যদি এখনি না করা হয়, তবে তারা কতটা দানবীয় হয়ে উঠবে তা অকল্পনীয়।

এমন অবস্থায় আমাদের জন্য দুটি বিকল্প রয়েছে: আমরা এখনই এটির সমাধান করতে পারি, অথবা এটি একটি সম্পূর্ণরূপে নিরাপত্তা সমস্যায় পরিণত হওয়ার পরে এটির সমাধানের জন্য অপেক্ষা করতে পারি৷ সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন ছাত্র হিসেবে আমি বুঝতে পারছি, এ সমস্যা সৃষ্টি হবেই। এবং এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা হবে না। এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা হয়ে উঠবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশের জন্য করণীয় কী? দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সমস্ত প্রথাগত এবং অপ্রথাগত নিরাপত্তা সমস্যাগুলিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর মোকাবিলা করার চেয়ে বাংলাদেশের উচিত সমস্যার পূর্বাভাস অনুধাবন করা ও মোকাবিলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা। দক্ষিণ-পূর্বের পরিস্থিতি, বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুকে স্বাভাবিকভাবে বা যেনতেন ভাবে দেখা উচিত না। মিয়ানমারের সাথে সমস্যাগুলি মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের উচিত একটি নিবেদিত দক্ষ বিশেষজ্ঞ দল মনোনীত করা, কারণ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতমাডও একটি ধূর্ত, চৌকস এবং দক্ষ সংস্থা। আমাদের মিয়ানমারের সামরিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য  বুঝতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ভারতের নিজস্ব স্বার্থ আছে যা আমাদের সাথে নাও মিলতে পারে। সুতরাং, ভারতীয় ব্যান্ডের সুর ও তালে মার্চ করা আমাদের জন্য উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে। তারপরে আবার, চীন এবং কোয়াডের সাথে জড়িত ভূ-রাজনৈতিক মাত্রা রয়েছে। এক্ষেত্রে সকল শক্তির কূটনৈতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সম্পর্কের ভারসাম্যমূলক সমন্বয়  অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সামরিক বিচারে সামরিক কুটনীতি ও উন্নয়ন এবং কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা মিয়ানমারের তাতমাডও-এর সম্ভাব্য দুঃসাহসিক কোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখতে সহায়ক হতে পারে।

লেখক: লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. মো. মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সাবেক প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
-সূত্র: ডেইলি স্টার থেকে অনূদিত
Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, মিয়ানমার, রোহিঙ্গা সমস্যা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন