parbattanews

‘দরকার হলে নিজের কয়েকটা আঙ্গুলই কেটে ফেলব’: মিয়ানমারের জনগণ

একের পর এক প্রদেশে বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে দিশেহারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। দেশটির বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে প্রতিনিয়ত হতাহত হচ্ছে সরকারি সেনারা, অনেকে বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে বা পালিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। এই অবস্থায়, জনবলের শূন্যতা পূরণে নতুন করে সেনা ভর্তির উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।

এজন্য কঠোর এক সেনাভর্তির আইন কার্যকর করেছে। এর আওতায় বছরে ৬০ হাজার তরুণ-তরুণীকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হবে। তাতে আরও ফুঁসে উঠেছে দেশটির জনগণ। আইনের নিন্দা জানিয়ে, সামাজিক মাধ্যমে জান্তাকে প্রতিরোধের ডাক নতুনভাবে দেওয়া হচ্ছে।

এতদিন তারা নিজেদের পেশাদের যোদ্ধাদের একটি বাহিনী বলে প্রচার করলেও– গত কয়েক মাসে কেবল পরাজয়ের মুখই দেখছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফলে সেনাভর্তির সাম্প্রতিক প্রক্রিয়াটি তাঁদের জন্য লজ্জাজনক এক পরিস্থিতির স্বীকারোক্তি।

সেনা সরকারের আনুষ্ঠানিক নাম– স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল বা এসএসি। গত শনিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে এসএসি জানায়, বাধ্যতামূলক সেনাদলে নিয়োগ আইন অবিলম্বে কার্যকর করা হচ্ছে। এর আওতায়, তরুণদের অন্তত দুই বছর সশস্ত্র বাহিনীর চাকরি করতে হবে। সংকটকালীন জাতীয় জরুরি অবস্থা বিবেচনায়, যা পাঁচ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়া, চিকিৎসক ও কারিগরি পেশাজীবীদের জন্য তা সর্বোচ্চ তিন বছর হয়ে পারে।

২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতাচ্যুত ও কারাবন্দি করে সামরিক বাহিনী। এরপরে বর্তমানেই তাঁরা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে।

সেনাদলে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পর্কে সামান্য তথ্যই দিয়েছে জান্তা সরকার। তবে জান্তার মুখপাত্র জ মিন তুন মঙ্গলবার বিবিসি বার্মাকে জানান, এই আইনের আওতায় এপ্রিল থেকে নিয়োগ শুরু হবে, প্রথম ব্যাচে ভর্তি করা হবে পাঁচ হাজার জনকে।

সমাজের প্রায় সকল স্তর থেকে লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হবে, এমন আভাস দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন, “সৈন্য ছাড়াও সামরিক বাহিনীতে কম্পিউটার প্রোগ্রামার, অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিকের মতো পেশাজীবীদের দরকার।”

তবে এতে জান্তা সরকারের ভরাডুবি ঠেকানো মুশকিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। নেদারল্যান্ডসের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতি বিশ্লেষক লেটিশিয়া ভ্যান ডেন আউম বলেন, সরকারের নতুন সেনাভর্তির আইনের ফলে উল্টো বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর নতুন সদস্য ভর্তির কার্যক্রম শক্তিশালী হতে পারে। একইসঙ্গে, সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহীদের অনুপ্রবেশ বাড়তে পারে, পাশাপাশি এটি এড়ানোর জন্য অনেকেই পালিয়ে যাবেন, যা নতুন শরণার্থীর ঢল সৃষ্টি করবে।

বিশেষজ্ঞদের এমন আভাসের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে মিয়ানমারের অন্তত ৩০ জন নাগরিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে জাপান-ভিত্তিক প্রভাবশালী গণমাধ্যম– নিক্কেই এশিয়া। একইসঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের ১০০টি পোস্টের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশিরভাগই প্রতিক্রিয়াই ছিল নেতিবাচক। এমনকি যারা এটি মানবেন বলে জানান, তাঁরাও এই ঘোষণাকে ভালোভাবে নেননি। আর অনেকেই বলেছেন, সামরিক বাহিনীতে ভর্তি এড়াতে হয় তাঁরা দেশ ছেড়ে পালাবেন, নাহলে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেবেন।

অন্যরা বলেছেন, ভর্তি এড়াতে নিজেদের জখম করতেও তাঁরা প্রস্তুত।

বিবাহিত নারীদের ভর্তি থেকে বাদ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে দেশটিতে। একারণে অনেক নারীই দ্রুত বিয়ে করে ফেলার পরিকল্পনা করছেন।

ইয়াঙ্গুন-ভিত্তিক একজন স্বাধীন বিশ্লেষক বলেন, বৌদ্ধ সন্যাসী হলেও সেনাভর্তি থেকে ছাড় দেওয়া হয়, পুরুষদের অনেকে সেকথাই ভাবছেন। নাহলে ভর্তি এড়াতে ‘সঠিক ব্যক্তিদের’ (পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের) ঘুষ দেওয়ার মতোন বিকল্পের কথাও ভাবছেন তাঁরা।

তিনি বলেন, “কত টাকা দিতে হবে- আমার বন্ধুরা সেটাও বলছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরুষদের মধ্যে এটাই বেশি কাজ করছে। অর্থাৎ, যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাঁরা (ঘুষ দিয়ে) ভর্তি ফাঁকি দিতে চায়। কিন্তু, যাদের এই সামর্থ্য নেই, তাঁরা আরও ভয়াবহ চিন্তা করছে। কেউবা মানব পাচারকারীদের সহায়তায় দেশ ছাড়তে চাইছে, কেউ কেউ নিজেকে পঙ্গু করা, বা সন্যাস গ্রহণের কথা ভাবছে।”

নিক্কেই এশিয়াকে সাক্ষাৎকার দেওয়াদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশই সামরিক বাহিনীতে ভর্তি করা হলে– সেখানকার শৃঙ্খলা মেনে চলবেন বলে জানান। কারণ, শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ডসহ অন্যান্য কঠোর সাজাকে ভয় পান তাঁরা।

ইয়াঙ্গুনের (সাবেক রেঙ্গুন) একজন বেসরকারি কোম্পানির চাকুরে হমিন ওয়েই বলেন, “তাঁরা আমাদের জোর করে মিলিটারিতে ভর্তি করলে, আমাকে তাঁদের কথা মেনে চলতে হবে, কারণ ঘুষ দেওয়ার মতো টাকা আমার নেই। কোথাও পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই আমার। কিন্তু, আমাকে যদি পিডিএফ (গণতন্ত্রকামী বিদ্রোহী দল) তরুণদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তার চেয়ে নিজে আত্মঘাতী হব।”

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাট চোকান ২০ বছরের এক শিক্ষার্থী জে। বর্তমানে তিনি অনলাইনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা গ্রহণ করছেন। জে জানান, প্রথমে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে, পরে পক্ষত্যাগ করবেন। “আমার সহপাঠীদের (অনলাইন ক্লাসের) অনেকে আমাকে কল করে কান্নাকাটি করেছে। আমরা সবাই হতাশ। তাঁরা যদি আমাকে আর্মিতে ভর্তি হতে বাধ্য করে, তাহলে আমি পিপলস এমব্রেস (সামরিক বাহিনী ত্যাগকারীদের জন্য একটি সংগঠন) এর সাথে যোগাযোগ করব, এবং পক্ষত্যাগের চেষ্টা করব।”

ইয়াঙ্গুনের একজন মাছ বিক্রেতা বলেন, ভর্তির এড়াতে “দরকার হলে আমি নিজের কয়েকটি আঙ্গুল কেটে ফেলব। তবু আর্মির চাকরি করব না। স্বদেশবাসীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব না।

জোরপূর্বক ভর্তির চিন্তায় উৎকণ্ঠিত বেসরকারি কোম্পানির কর্মীরা। মিয়ানমারের স্থানীয় ও সেখানে ব্যবসারত বিদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ী তাঁদের কর্মীদের মধ্যে এই ভীতির কথা উল্লেখ করেন। এতে বিনিয়োগ প্রভাবিত হওয়ার পাশাপাশি কর্মীদের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ছে বলেও জানান তাঁরা। তবে তাঁদের আশা, শুরুতে সেনাভর্তির কার্যক্রম ইয়াঙ্গুনের বাইরের এলাকাগুলোয় পরিচালিত হবে।

একজন নির্বাহী বলেন, “আমাদের কর্মীরা খুবই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। দেশত্যাগ বা বিদ্রোহী দলে নাম লেখানোর মতো অনেকেই বিভিন্ন উপায়ের কথা ভাবতে শুরু করেছে। তবে শুরুতেই জান্তা সরকার ইয়াঙ্গুনের অফিস কর্মীদের ভর্তির উদ্যোগ নেবে বলে মনে হয় না। কিন্তু, দুঃখের বিষয় অপ্রধান ছোট শহরগুলোর দিকে তাঁদের নজর থাকবে, যেখানকার বেশিরভাগ মানুষেরই ঘুষ দিয়ে ভর্তি এড়ানোর সামর্থ্য নেই।”

Exit mobile version