দিঘীনালা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত প্রার্থীরা

 election photo

দিদারুল আলম রাফি, উপজেলা প্রতিনিধি, দিঘীনালা:

আসন্ন দিঘীনালা উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকরা। দিনব্যাপী গণসংযোগ, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট প্রার্থনা, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি করেই প্রচারণা চালানোর শেষ দিনে তুমুল দৌড়ঝাঁপ প্রার্থীদের। আজ রাত ১২ টায় শেষ হচ্ছে প্রচারণা চালানোর নির্ধারিত সময়সীমা।

আসন্ন দিঘীনালা উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৯ জন প্রার্থী, ভাইস-চেয়ারম্যান পদে ৪ জন ও নারী ভাইস-চেয়ারম্যান পদে ৩ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। চেয়ারম্যান পদে ৯ জনের মধ্যে ৬ জন উপজাতি প্রার্থী ও ৩ জন বাঙালি প্রার্থী, ভাইস-চেয়ারম্যান পদে ৪ জনের মধ্যে ২ জন পাহাড়ি ও ২ জন বাঙালি, নারী ভাইস-চেয়ারম্যান পদে ২ জন উপজাতি ও ১ জন বাঙালি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দিঘীনালা উপজেলার মোট ৬৫,৮৭৩ জন ভোটারের প্রায় দুই ভাগ উপজাতি ও ১ ভাগ বাঙালি ভোটার।

চেয়ারম্যান পদে উপজাতি ৬ জন প্রার্থীর মধ্যে আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ-এর নব কমল চাকমা, জেএসএস (সংস্কার)-এর চয়ন বিকাশ চাকমা (কালাধন), বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ধর্মবীর চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ সাবেক সভাপতি রিপন চাকমা, স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রিয়দর্শী চাকমা, জেলা বিএনপি’র প্রচার সম্পাদক ও বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী খনি রঞ্জন ত্রিপুরা আছেন নির্বাচনী লড়াইয়ে। দিঘীনালায় বেশ কয়েকবছর ধরেই পাহাড়ি আঞ্চলিক দল স্বশস্ত্র ইউপিডিএফ ও জেএসএস (সংস্কার) শক্তিশালী অবস্থানে আছে। গতবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ধর্মবীর চাকমা জেএসএস (সংস্কার)-এর প্রার্থী ছিলেন। তবে এবার তাদের সমর্থন চয়ন বিকাশ চাকমার দিকে। উদারপন্থী বলে পরিচিত চয়নবিকাশ এগিয়ে আছেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি। ধর্মবীর তাঁর সময়ে তেমন আক্রমণাত্নক ছিলেন না বলে সাধারণ পাহাড়িদের ভোট পাবেন মোটামুটি। চয়নবিকাশ চাকমা আর ধর্মবীরের ভোট কাটাকাটি হতে পারে মূলত ইউপিডিএফ-এর ভোট ব্যাংক থেকে। ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী নবকমল চাকমার ভোট ব্যাংক মূলত বাবুছড়ার বিশাল পাহাড়ি ভোটাররা। কিন্তু সেখানে ভাগ বসাতে তৈরী হয়ে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বাবুছড়ার ঘরের ছেলে প্রিয়দর্শী চাকমা। শিক্ষিত প্রিয়দর্শী চাকমা বেশ ভোট পাবেন বলে আশা করা যায়। গতবার বাবুছড়া ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন প্রিয়দর্শী চাকমাই। তাঁর ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না সেবার!  তবে সেবার প্রিয়দর্শী চাকমা ছিলেন ইউপিডিএফ সমর্থিত প্রার্থী। তাই এবার ইউপিডিএফ-এর দূর্গ গুলোতে কীভাবে আঘাত করতে পারবেন তিনি, সেটাই মূখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবুছড়াতে এবার ভোট কাটতে পারেন রিপন চাকমাও।

ইউপিডিএফ, জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত আর বাকী তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী যথাক্রমে ধর্মবীর, প্রিয়দর্শী আর রিপন চাকমার আরেক ভোট ব্যাংক দিঘীনালা ইউনিয়ন। সেখানে এবার এই ৫ জনের মধ্যে বেশ লড়াই হবে। তবে জেএসএস আর ইউপিডিএফ-এর অস্ত্রের দাপটে বাকী ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীর ব্যাক্তিগত সামর্থ্য কতটুকু কাজে দেবে সেটাই দেখার বিষয়। গতবার ধর্মবীর আর প্রিয়দর্শীই ছিলেন সেখানে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে এবার তাদের আঞ্চলিক দলের সমর্থন নেই।

ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের একমাত্র প্রার্থী খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি’র প্রচার সম্পাদক ও বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী খনিরঞ্জন ত্রিপুরা বিএনপি’র জন্য যেন শাপে বর হয়ে এসেছেন। সাধারনত ত্রিপুরা সম্প্রদায় থেকে সামান্য কিছু ভোট পেয়ে থাকে বিএনপি, তবে অধিকাংশ ভোট যায় আওয়ামী লীগ বা আঞ্চলিক দলের দিকে। এছাড়া খাগড়াছড়ির বর্তমান এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি  কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার নিজ বাড়ি দিঘীনালা হওয়ায়, তাঁর ব্যাপক প্রভাব আছে এখানকার ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের উপর। হুমকি ধমকি দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলোও ত্রিপুরাদের বেশ কিছু ভোট পেয়ে থাকে। খনিরঞ্জন ত্রিপুরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের বাড়া ভাতে ছাই দিলেন বলে মনে হচ্ছে। তবে খনিরঞ্জনের প্রচারনা অনেকটাই অনুজ্জ্বল।

চেয়ারম্যান পদে বাকী ৩ জন প্রার্থী বাঙালি। তারা হলেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি’র পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক, মেরুং ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব কাশেম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আমজাদ হোসেন। এবার ৬ জন উপজাতি প্রার্থী মাঠে থাকায়, দিঘীনালায় বাঙালি প্রার্থীদের জয়ের বন্ধ্যাত্ব ঘুচতে পারে বলে ভাবা হচ্ছে। দিঘীনালায় বাঙালি ভোটাররা মূলত বিএনপি সমর্থিত হলেও, আওয়ামী লীগের আলহাজ্ব কাশেম বেশ প্রভাবশালী। এছাড়া বেশ কয়েকজন বিএনপি কর্মীকে বাগে নিয়ে এনে এবার ভোট করছেন কাশেম। চট্টগ্রামের বেশ কিছু আঞ্চলিক ভোট, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটারদের ভোট ও ব্যাবসায়ীদের কিছু ভোট নির্বাচনে বিপুল অর্থ ব্যয় করা ব্যাবসায়ী কাশেমের ঘরেই যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

তবে বিএনপি ঘরানার বাঙালি সাধারণ ভোটারদের ভোট বিএনপি সমর্থিত মোশাররফ হোসেনের দিক থেকে নড়বে বলে মনে হচ্ছে না। বাঙালিদের বিশাল ভোট ব্যাংক গুলো হচ্ছে প্রায় ২২, ০০০ ভোটার সমৃদ্ধ মেরুং ইউনিয়ন, প্রায় ১৩ হাজার ভোটার সমৃদ্ধ ২ নং বোয়ালখালী ইউনিয়ন, প্রায় ১১, ৫০০ ভোটার সমৃদ্ধ কবাখালী ইউনিয়ন। মূলত মেরুং-এর ভোটাররাই গড়ে দিতে পারে পার্থক্য। সেখানে পুনর্বাসিত বাঙালিদের মাঝে ওয়াদুদ ভূইয়ার অসম্ভব জনপ্রিয়তা আর মেরুং-এর ঘরের ছেলে হওয়ার সুবাদে এগিয়ে আছেন মোশাররফ হোসেন। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব কাশেম মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন সেখানে ভোট আদায় করতে।  বসে নেই বিএনপি’র কর্মীরাও। গণসংযোগ, প্রচার-প্রচারনায় চষে বেড়াচ্ছে তারা উপজেলা জুড়ে। জেলা বিএনপি’র বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অনেকদিন ধরেই অবস্থান করছেন দিঘীনালায়। এছাড়া ওয়াদুদ ভূইয়া স্বয়ং নেতাকর্মীদের সার্বক্ষণিক সরাসরি দিক নির্দেশনা দেওয়ায় উদ্দিপ্ত নেতাকর্মীরা। বিএনপি এবার চেয়ারম্যান পদটি দখল করতে মরিয়া। এক্ষেত্রে খুবই পিছিয়ে আছেন মেরুং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তুলনামূলক অপরিচিত প্রার্থী আমজাদ হোসেন। তিনি বলতে গেলে নামেমাত্র প্রচারনায় সময় পার করছেন। মাঠে দেখাই যাচ্ছে না তাকে।

 ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুইজন পাহাড়ি, দুইজন বাঙালি। ভাইস চেয়ারম্যান পদে উপজাতি ভোটার সংখ্যার আধিক্যের কারনে এগিয়ে আছেন দুই পাহাড়ি প্রার্থীই। আর বাঙালিদের মধ্যে লড়াই বিএনপি’র সাথে বিএনপি’রই। পাহাড়িদের মধ্যে আছেন গতবারের দুই নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুপ্রিয় চাকমা (বর্তমান ভাইস-চেয়ারম্যান) ও সুসময় চাকমা। আর বাঙালিদের মধ্যে উপজেলা যুবদলের সাধারন সম্পাদক ও বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুর রহমান এবং বিএনপি সমর্থিত সদ্য সাবেক ইউপি সদস্য আবদুস সালাম আছেন মাঠে। বলাই বাহুল্য এখানে জয়ের পাল্লা উপজাতিদের দিকেই ভারি।

 মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সম্ভাবনা আছে বাঙালি একক স্বতন্ত্র প্রার্থী আফরোজা আলমের। তিনি মেরুং ইউনিয়নের বাসিন্দা। সেখানে বাঙালি সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ভোট পাবেন তিনি। অপরদিকে দুই উপজাতি নারী প্রার্থী হচ্ছেন যথাক্রমে জেএসএস (সংস্কার) সমর্থিত বাবুছড়া ইউনিয়নের সদ্য সাবেক মহিলা সদস্য গোপা দেবী চাকমা আর ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সভানেত্রী সোনালী চাকমা। দুই উপজাতি নেত্রীই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাবশালী। তাই উপজাতি ভোট কাটাকাটি হতে পারে প্রচুর। ফাঁকে সুবিধা লুফে নিতে পারেন একক বাঙালি প্রার্থী আফরোজা আলম।

 মোশাররফ হোসেন এগিয়ে থাকলেও বিএনপি’র শতভাগ সাধারন ভোট পেতে কষ্ট হতে পারে তাঁর। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভোটাররা সাধারনত বিএনপি’র হলেও, নিজ অঞ্চলের হওয়ায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাশেমের ঘরে যেতে পারে তাদের অনেক ভোট। বাঙালি আওয়ামী লীগ সমর্থকের ভোটও কাশেম পাচ্ছেন। ব্যাবসায়ীক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার তাগিদে ও ভবিষ্যতে নিজেদের ব্যাবসা হূমকির মুখে না ফেলতে অনেকেই চান না প্রভাবশালী কাশেমকে চটাতে। তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে পাল্টা হুমকি আছে বিএনপি’রও। ব্যাবসায়ীক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার অজুহাতে যেসব বিএনপি সমর্থক ব্যাবসায়ীরা কাশেমের পক্ষে কাজ করেছেন, বিশেষ করে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন জেলা বিএনপি’র শীর্ষ কয়েকজন নেতা।

 কথা বলে জানা গেছে, সকল সাধারণ ভোটাররা আশা করছেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত ভোট ডাকাতি হবে না এখানে এবং তারা নিরাপদে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। তবে এখন পর্যন্ত এই উপজেলায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। উপজেলাজুড়ে আট জন মেজিস্ট্রেট নির্বাচনী আচরণবিধি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষন করছেন বলে দেখা গেছে। উপজেলার ২৫ টি কেন্দ্রের মধ্যে ১২ টি কেন্দ্র ঝুকিপূর্ন ঘোষণা করা হয়েছে। একটি কেন্দ্রে ব্যাবহৃত হবে হেলিকপ্টার। নির্বাচন উপলক্ষ্যে সেনাবাহিনীর টহলদলকেও দেখা যাচ্ছে রাস্তায়। উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুই দিন ব্যাপী পোলিং এজেন্টদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজিত হয়েছে। তবে প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকেরা প্রতিটি ক্ষন গুনছেন ঢিবিঢিবি বুকে।

এখন পর্যন্ত আগাম বিশ্লেষণ করা গেলেও, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলের উপজাতি ভোটারদের উপর কোনো উপজাতি প্রার্থী যদি তুলনামূলকভাবে অত্যধিক বেশি মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, তাহলে পরিস্থিতি মোশাররফের দিক থেকে নড়ে গেলেও যেতে পারে। আর সারাদেশের মত জাল ভোটের মহোৎসব হলেও উল্টে যেতে পারে বিশ্লেষন, ফল ঘরে তুলতে পারেন আলহাজ্ব কাশেম অথবা বাঙালি ভোট কাটাকাটির সুবিধা তুলতে পারেন দুর্গম অঞ্চলে অত্যধিক এগিয়ে থাকা কোন উপজাতি প্রার্থী।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন