parbattanews

দিল্লির রোহিঙ্গা নীতির বিরোধিতা ভারতের ভেতরেও

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

ভারত সরকার আদালতে হলফনামা দিয়ে সে দেশে বসবাসকারী চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গাকে দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে চিহ্নিত করার পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিবিসিকে বলেছে, ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্ত হল হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে ‘সমবেত শাস্তি’ দেওয়ার সামিল এবং কোনভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোর করে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা মেনে নেওয়া যায় না।

ভারতের মধ্যেও একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত নন।

সুপ্রিম কোর্টে ষোলো পাতার দীর্ঘ হলফনামা পেশ করে ভারত সরকার গতকাল দাবি করেছিল রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ভারতের নিরাপত্তাকে বিরাট হুমকিতে ফেলেছে – কারণ তারা ভারত-বিরোধী কাজে লিপ্ত এবং বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা বা আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোও তাদের নাশকতামূলক কাজে জড়িয়ে ফেলছে।

বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গারা অনেকে জাল ভারতীয় পাসপোর্ট পর্যন্ত জোগাড় করে ফেলেছেন – এবং তারা মিয়ানমারের ঘটনার বদলা নিতে ভারতেও বৌদ্ধদের ওপর হামলা চালাতে পারে।

কিন্তু নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে একসঙ্গে ও একই অপরাধে এভাবে অভিযুক্ত করা যায় না।

সংগঠনের সাউথ এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বিবিসিকে বলেছেন, “ভারত সরকারের হিসেব মতো যে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা সে দেশে আছেন, হতে পারে যে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিরাপত্তা ঝুঁকি। কিন্তু চল্লিশ হাজার লোকের সবাই তো আর নিরাপত্তা ঝুঁকি হতে পারেন না, তাই তাদের সমবেত শাস্তি দেওয়াও কিছুতেই উচিত নয়।”

“যদি কারও বিরুদ্ধে সন্দেহের কারণ থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করে বা কোর্টে সাক্ষ্যপ্রমাণ পেশ করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় তার বিচার হোক। কিন্তু একটা ঢালাও অভিযোগ করে আপনি চল্লিশ হাজার লোককে বের করে দেবেন, এটা তো সব রীতিনীতির বিরুদ্ধে,” বলেন মিস গাঙ্গুলি।

ভারত সরকার বেশ কয়েক সপ্তাহ আগেই বিভিন্ন রাজ্যে চিঠি দিয়ে সেখানে অবৈধভাবে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গ সে নির্দেশ এখনও মানেনি – আর কেন্দ্রের হলফনামা যা-ই বলুক, সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও বলছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না সব রোহিঙ্গাই জঙ্গি।

কেন্দ্রের হলফনামা পেশের পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “ওরা আমাদের আগেই বলেছিল রোহিঙ্গা শিশুসহ সবার তালিকা তৈরি করে ডিপোর্ট করতে। কিন্তু আমাদের শিশু সুরক্ষা কমিশন তাতে রাজি হয়নি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি সব সাধারণ মানুষ কিছুতেই সন্ত্রাসবাদী হতে পারে না।”

“আসলে প্রত্যেকটা কমিউনিটিতেই খারাপ লোক, ভাল লোক থাকতে পারে। কিন্তু কমিউনিটি মানে কমিউনিটি। সাধারণ লোক আর সন্ত্রাসবাদীর মধ্যে তো পার্থক্য আছে – কেউ সন্ত্রাসবাদী হলে তার বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিক, কিন্তু তাই বলে তো সব সাধারণ মানুষকে দুর্দশায় ফেলা যায় না!”

বস্তুত কেন্দ্রের এই পদক্ষেপকে জাতিসংঘের মানবতা সনদের বিরোধী বলেও বর্ণনা করেছেন মিস ব্যানার্জি।

কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির শরিক, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে বলেছেন, তিনিও ব্যক্তিগতভাবে ‘মানবিকতারই পক্ষে’।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মীনাক্ষী গাঙ্গুলীও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ভারতের কোনও রাজ্যেই কিন্তু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যকলাপের অভিযোগে কোনও মামলা নেই।

“এটা তো হতেই পারে না যে আমাদের দেশে চল্লিশ হাজার নিরাপত্তা-ঝুঁকি ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে এতদিন কোনও ব্যবস্থা হয়নি – তাদের বিরুদ্ধে কোনও পুলিশ কেসও হয়নি। ফলে এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!”

“আসলে আমাদের ধারণা গত মাসে পার্লামেন্টে ভারত সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে সেটাকে আঁকড়ে থাকতেই মুখ বাঁচানোর জন্য এসব কথা বলছে। আমাদের দাবি, ভারত সরকার তাদের এই নীতি প্রত্যাহার করুক এবং রোহিঙ্গাদের ততদিন ভারতে থাকতে দিক যতদিন না মিয়ানমার সরকার তাদের এথনিক ক্লিনসিং বন্ধ করে ও সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়,” বলেন মিস গাঙ্গুলি।

ভারতে অ্যাক্টিভিস্টরা কেউ কেউ এ কথাও বলছেন, গত পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছরে দেশের সব রাজ্য মিলে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে শুধু হাতে গোনা কয়েকজনের বিরুদ্ধে পকেটমারি বা ওই ধরনের পেটি অপরাধে কিছু মামলা হয়েছে।

এখন সরকার যদি তাদের সবাইকে দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক বলে দাবি করে তার চেয়ে অবাস্তব ও হাস্যকর কিছু হতে পারে না।

সূত্র: বিবিসি

Exit mobile version