নদী ড্রেজিংয়ে দুর্নীতি করলো ঠিকাদার, খেসারত দিচ্ছে জনগণ

fec-image

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজার জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে করে জেলায় প্রায় ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তবে শুক্রবার সকাল থেকে বৃষ্টি কমে আসায় কিছু কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে।

এদিকে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতে কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলার বিশাল একটি সমতল এলাকাও অস্বাভাবিকভাবে প্লাবিত হয়েছে। এতে দুই উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। গত তিনদিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুই উপজেলার লক্ষাধিক বাসিন্দা। তবে প্রায় ২০০ কেটি টাকা ব্যয়ে বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ের পরেও এ ধরনের বন্যা মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই।

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের অভিযোগ, কক্সবাজারে অতি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ে ব্যাপক অনিয়ম, ‘পুকুর চুরির’ খেসারত দিচ্ছে তারা। একই সাথে নদী ড্রেজিংয়ের সব টাকাও অপচয় করা হয়েছে বলেও দাবি তাদের।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সদরের ঝিলংঝা, পিএমখালী ইউনিয়ন ছাড়াও রামু উপজেলার ফঁতেখারকুল, কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, কাউয়ারখোপ, ঈদগড়, রাজারকুল, চাকমারকুল ও দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। বুধবার থেকে রামুতে গুরুত্বপূর্ণ চারটি সড়কও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

রামু উপজেলার ফাঁতেখারকুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম বলেন, আমার আশংঙ্কা সত্যি হলো, বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ে ব্যাপক অনিয়ম, পুকুর চুরির খেসারত এখন আমার ইউনিয়নের ৫০ হাজার বাসিন্দাকে দিতে হচ্ছে। মাত্র দুইদিনের বর্ষণে আমার পুরাে ইউনিয়ন এখন পানিতে ডুবে গেছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে ঘরবাড়ি। বাঁকখালী নদীর তিনটি পয়েন্ট দিয়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি ঘর পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম, বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ে ‘পুকুর চুরি’ করা হয়েছে। আমার ইউনিয়নে ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার বাঁকখালী নদী রয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্টরা তাদের ইচ্ছেমতো ড্রেজিং করেছে। বেশিরভাগ অংশে তাদের হাতও পড়েনি। আবার যেটুকু ড্রেজিং করা হয়েছিল তাও নদীর পাড়ে তারা রাখে। এসব বালু বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়ে আবার ভরাট হয়ে গেছে।

একই ধরনের অভিযোগ করে দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইউনুস ভুট্টো বলেন, আমার ইউনিয়নের ২০ হাজার ঘরবাড়ি রয়েছে। গত দুইদিনের বর্ষণে বাঁকখালী নদীর পানিতে ১৫ হাজার মতো বসতি ডুবে গেছে। এতে করে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বাঁকখালী নদী যদি ভালো করে ড্রেজিং করা হতো, আজকে এ অবস্থা হতো না।

তিনি বলেন, আমার ইউনিয়নের দুই কিলোমিটার নদীর অংশে কিছু কিছু স্থানে ড্রেজিং করা হয়েছিল, তা ড্রেজিং শেষ হওয়ার আগে আবার ভরে গেছে। এটাকে নদী ড্রেজিং বলা যায় না।

বাঁকখালী নদীর পাশ্ববর্তী সদরের ঝিলংঝা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, দুইদিনের বর্ষণে আমার ইউনিয়নের ৪ থেকে পাঁচ হাজার ঘর পানিতে ডুবে গেছে। এতে করে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমার বাড়ির ভেতরও এখন থেকে চার ফুট পানি- যা এতদিন আমি কল্পনাও করিনি।

একই অবস্থা সদরের পিএমখালী, রামু উপজেলার কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, রাজারকুল, চাকমারকুলসহ আরও কয়েকটি ইউনিয়নেও।

পিএমখালীর বাসিন্দা শাহী কামরান বলেন, বাঁকখালী নদী থেকে বালু উত্তোলন করে বাংলাবাজার স্টেশনের পশ্চিমে বিশাল বালুর স্তুপ করা হয়েছিল। ওই সময় বালু উত্তোলনের ফলে পানি নিস্কাশনের পথঘাটসহ ঝিলংজা ও পিএমখালী ইউনিয়নের মধ্যবর্তী ভরা খালও ভরাট হয়ে গেছে। পরবর্তী এসব পানি নিষ্কাশনের জায়গা আর ড্রেজিং করে দেয়নি সংশ্লিষ্টরা। এতে করে এখন দ্রুত পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে গত দুই দিনের বর্ষণে পিএমখালী ও ঝিলংঝা ইউনিয়নের বেশিরভাগ বাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ের নামে হরিলুটের কারণে আমরা এলাকাবাসী আজ পানিবন্দী হয়ে পড়েছি। নদীর ড্রেজিং ঠিকটাক মত করা হলে এবং বালু উত্তোলন পরবর্তী পানি নিস্কাশনের জায়গা ড্রেজিং করা হলে, আজকের চিত্র ভিন্ন হত।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, আমি যে আশংঙ্কা করেছিলাম সে আশংঙ্কাটাই সত্যি হয়েছে। এখন রামুর বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছে।

তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ একটাই, তা হল বাঁকখালী নদী ভালোমতোই ড্রেজিং করতে হবে এবং উপরের অংশে আরও কয়েকটি ইউনিয়নে নদী ড্রেজিং করা জরুরি।

প্রসঙ্গত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য ২০১৬ সালে প্রায় ১৯৫ কোটি ৫৪৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্প গ্রহণ করে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য-বাঁকখালী নদী ড্রেজিং ও খনন করে নদীর নাব্য বাড়ানোর মাধ্যমে নৌচলাচলের পথ সুগম করা এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নদী ভাঙনের হাত থেকে ঘরবাড়ি রক্ষা করা।

প্রকল্পে ২৮ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং ছাড়াও ৪ দশমিক ৬৫০ কিলোমিটার নদীতীর সংরক্ষণ, তিন কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ/পুনরাকৃতিকরণ, দুটি রেগুলেটর নির্মাণ ও ১২ কিলোমিটার খাল পুনঃখনন করা হবে। ২০১৬ সালের জুনে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ জুনে শেষ হয়েছে। ড্রেজিংয়ের কাজ শেষে ফিনিশিংয়ের কাজ চলছে।

অভিযোগ আছে, ট্রেস ম্যাপ অনুযায়ী নদী ড্রেজিং করা হয়নি। নদী ড্রেজিংয়ে মনোযোগের পরিবর্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বালু লুটে ব্যস্ত ছিল। অনুমোদনপত্র ছাড়াই গোপনে ম্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চলমান রেললাইন ও স্থানীয় বালুদস্যুদের কাছে কোটি কোটি টাকার বালু বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে।

শুধু রামু উপজেলার একটি পয়েন্ট থেকে সম্প্রতি ৬ কোটি টাকার বালু গোপনে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ উঠে। তদন্তে নেমে এই অভিযোগের সত্যতাও পায় জেলা প্রশাসন। একইভাবে ২৮ কিলোমিটার বাঁকখালী নদী ড্রেজিং করে উত্তোলন করা বেশিরভাই বালু লুটপাট করা হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।

অভিযোগ স্বীকার করলেও তার বিপরীতে রাজস্ব দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ড্রেজিংয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এর কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. সরওয়ার আলম।

সেভ দ্য নেচার বাংলাদেশের এর চেয়ারম্যান আ.ন.ম. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ে শুধু অনিয়ম নয়, ভূমিদস্যুদের স্বার্থে ঝিলংঝায় একটি পয়েন্টের নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয়েছে। নদী ড্রেজিংয়ের নামে সিন্ডিকেট করে সরকারের শত কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ড্রেজিংয়ে অনিয়ম, গোপনে বালু বিক্রি ও ড্রেজিংয়ের পরেও বন্যার বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড-এর কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. সরওয়ার আলম বলেন, এখন মোবাইলে এ বিষয়ে কথা বললে আপনি আবার নিউজ করে দিবেন। তার চেয়ে ভালো বসে কথা বলি, তখন না হয় সব তথ্য দেবো।

জানতে চাইলে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাইবো) এর নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, টানা ভারী বর্ষণের কারণে পুরাে জেলাব্যাপী এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নদীর ড্রেজিংয়ে অনিয়মের কারণে বন্যা হয়েছে বলে যে বা যারা দাবি করছে তা বাস্তবসম্মত নয়।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ বলেন, বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ে অনিয়মের অভিযোগ যাচাইয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত ও কারিগরি বিশ্লেষণ প্রয়োজন আছে। তবে যেসব স্থানে ড্রেজিংয়ের পর বালু উত্তোলনের কারণে পানি নিস্কাশনের পথ বন্ধ হয়েছে বলে বলা হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে-গোপনে নদীর বালু বিক্রির অভিযোগের বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ডিসি বলেন, বিষয়টি আমাকে একটু জেনে বলতে হবে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলে তা পুনরায় ড্রেজিং করা না হলে ভারী বর্ষণ শুরু হলে ভয়াবহ বন্যার আশংঙ্কা করেছিলেন রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা।

অভিযোগ অনুসন্ধান করে গত ৬ জুলাই একুশে পত্রিকায় ‘বাঁকখালী নদী ড্রেজিংয়ের ১৯৫ কোটি টাকাই জলে, তীব্র বন্যার আশঙ্কা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের মাত্র ২০ দিনের মধ্যে বন্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে কক্সবাজার ও রামুর দুই উপজেলার বাসিন্দাদের।

যদিও ওই সময় সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ অস্বীকার করে বন্যা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই দাবি করে, উল্টো কয়েক লাখ মানুষ বাঁকখালী নদীর ড্রেজিংয়ের সুফল পাবে বলে মন্তব্য করেছিলেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন