বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির বাদুরঝিরিতে পাহাড়িদের নামে রেকর্ডভুক্ত কোন ভুমি নেই

Banbarban pic- 7.6.2013

জমির উদ্দিন:

বান্দরবানে নাইক্ষংছড়ির বাদুরঝিরি পাড়া কিংবা এর আশপাশে কোনো পাহাড়ির নামে এক ইঞ্চি ভুমি রেকর্ডভুক্ত নেই। রাষ্ট্রের ভাতায় যিনি পাড়া প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন, সেই খিজারি কার্বারিরও ভুমি নেই। স্বাধীনতা পূর্ব থেকে কৃষি আবাদের আওতায় আসে বাদুরঝিরি। ভূমি অফিসের রেকর্ড অনুযায়ী এ সময়ের মধ্যে কার্বারিসহ কেউ ভুমির জন্য আবেদন করেননি। তবে ১৯৮৫ সালে সামসুল আলম নামে এক ব্যক্তির অনুকূলে ৫ একর জমি বন্দোবস্তির আদেশ হয়েছে।
সামপ্রতিক সময়ে সংবাদ মাধ্যমে বেশ আলোচিত বাদুরঝিরি থেকে পাহাড়িদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার প্রকৃত কারণ খুঁজতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন পরিদর্শনে এসব তথ্য জানা গেল।

পাড়ার কার্বারি খিজারি চাক জানান, জমি চাষ করার জন্য তিনি মৌজা হেডম্যানের কাছ থেকে ৫ একর করে ৬টি প্লট নিয়েছেন। কিন্তু বন্দোবস্তির জন্যে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেননি। এ পাহাড়ি গ্রামে এতদিন ১৪টি পরিবারের বসবাস ছিল। গত ১৩ মার্চ ডাকাতির ঘটনার পর ১০ পরিবার বাইশারি ইউনিয়ন সদরের আশপাশে বসতিস্থাপন করেছে। এ ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উপ-সচিব মোহাম্মদ আলমগীর হোসেনকে প্র্রধান করে ১ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে গত ২০ জুন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্যে আলেক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান চ হ্লা মং মারমাকে বরখাস্ত করেন।
এদিকে বাদুরঝিরি থেকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এবং মৌজার দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যর্থতা ছিল কি না, তা তদন্তের জন্যে বোমাং রাজার পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ১ এপ্রিল এ কমিটি ঘটনাস্থলের অদূরে নতুন চাকপাড়ায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ের গঠন এবং ভূমি প্রকৃতিগত উপযোগিতার কারণে ১৯৮০ সাল থেকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে বাণিজ্যিক রাবার চাষ শুরু হয়। অবসরপ্রাপ্ত আমলা, কূটনীতিক, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী গ্রুপসহ দেশের খ্যাতিমানদের অনেকে এ সময় রাবার চাষের জন্যে ২৫ একর করে জমি লিজ নেন। প্রথমে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং পরে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ব্যক্তি বিশেষকে রাবার চাষের প্লট লিজ দেন।
জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার আলেক্ষ্যং মৌজার মোট ভুমির পরিমাণ ১১ হাজার ২১৯ একর ২০ শতক। রাবার চাষের জন্য জমি লিজ প্রদান প্রক্রিয়ায় এ মৌজায় ৬৩টি প্লটের অধীনে ১৫৭৫ একর ভুমি মধ্য মেয়াদি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর বাইরে ‘আর হোল্ডিং’ (পুনর্বাসন) এবং সাধারণ হোল্ডিংয়ের আওতায় আরো ১৫০০ একর জমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্তি দেওয়া হয়। সে হিসাবে এ মৌজায় ৮ হাজার একরেরও বেশি ভুমি সরকারি খাস খতিয়ানে দখলমুক্ত থাকার কথা।

কিন্তু গত শুক্রবার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঘুরে এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে কারো দখল বা অপদখলে নেই এমন এক টুকরো ভুমির অস্তিত্ব আলেক্ষ্যং মৌজায় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাদুরঝিরি যাওয়ার পথে নতুন চাকপাড়ার মুখে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ‘শাহ্ সিরাজুল রহমান (সজল) সাহেব’ এর রাবার বাগান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ধনাঢ্য ব্যক্তি সজলের দখলকৃত এ বাগানের অনুকূলে কোনো লিজ বা বন্দোবস্তি আদেশ নেই। তিনি সব সময় সরকারি দলের স্থানীয় নেতা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্থানীয় দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির প্রধান ছিলেন। বান্দরবান সরকারি সার ডিলারের সভাপতিও তিনি। স্থানীয় প্রশাসন, বড় নেতা, আমলা এবং অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে তার নিয়মিত উঠাবসা থাকায় কেউ তার সম্পর্কে তথ্য দিতে সাহস পান না।

নতুন চাকপাড়ায় পৌছাতেই দেখা মিলল ভিকটিমদের অন্যতম মোনাই চাক নামে পাঁচ সন্তানের জননীর। ১৩ মার্চের ডাকাতির ঘটনার পর বাদুরঝিরি থেকে পালিয়ে এসে একটি ঝিরিরপাড়ে জেলা প্রশাসকের দেওয়া ঢেউটিন দিয়ে অস্থায়ী ঘর তুলে বসবাস করছেন তিনি। চাক সম্প্রদায়ের সন্তান হলেও ১৯ বছর আগে বিয়ে করেন মারমা যুবককে। বিয়ের পর লামা উপজেলার আজিজনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় বসবাসের পর উন্নত জীবিকার আশায় বছর পাঁচেক আগে বাদুরঝিরি আসেন তারা। কিন্তু সেখানেও থাকতে না পেরে এখন উদ্বাস্তু জীবনে। সাংবাদিক পরিচয় জানতে পেরে মোনাই চাক জানান, পূর্ণ নিরাপত্তা পেলে তিনি আবারো বাদুরঝিরি ফিরে যেতে চান।

বাদুরঝিরির কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেল, এক সময়ের উর্ব্বর ভুমিবিশিষ্ট এ পাড়ার আশপাশে প্রায় ১ হাজার একর পাহাড়ি ভুমি আছে। কিন্তু এখন পাড়ার উত্তর দিকের সবটাই ভূমিহীন সমিতির নামে সাবেক চেয়ারম্যান সামসুল আলম গংদের দখলে। দক্ষিণে পাড়া লাগোয়া ভুমি কিনে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আলম মাঝি। পূর্ব দিকের অংশ জয়নাল নামে একজনের দখলে এবং পশ্চিম অংশ নুরুল হক মেম্বারের কব্জায়।
খিজারি কার্বারি জানান, একটি মারমা পরিবারসহ ১৪ পরিবারের দখলে ছিল ১৯০ একর ভুমি। বন্দোবস্তি না থাকা সত্ত্বেও ১৩ মার্চের ডাকাতির ঘটনার পর ৬৫ একর জমির পজেশন (দখল) বিক্রি হয়ে গেছে। বাকি ভুমির ওপরও তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। এ অবস্থায় দুই বেলা দুই মুঠো খাবারের জন্য এলাকা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।

মৌজা হেডম্যান বরখাস্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন: বাদুরঝিরি ঘটনায় গঠিত সরকারি তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য মৌজা হেডম্যান চ হ্লা মংকে বরখাস্ত করে পরবর্তী হেডম্যান নিয়োগ না করা পর্যন্ত ঈদগড় মৌজার হেডম্যান থোয়াই হ্লা অং মারমাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। বরখাস্তকৃত হেডম্যান ৩০ জুন সকালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে মৌজার সকল সরকারি দলিলপত্র বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার অপসারণকে ভালো চোখে দেখছেন না এলাকাবাসী।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বাইশারি ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ক্য চিং মং জানান, উপসচিবের নেতৃত্বে তদন্তকালে তিনিসহ অন্যরা আলেক্ষ্যং মৌজার হেডম্যান চ হ্লা মংকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী না করে অপরাধের মূল শেকড় বের করার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহবান জানান। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তার  প্রতিবেদনে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি।

বরখাস্তকৃত হেডম্যান চ হ্লা মং জানান, বাদুরঝিরিসহ তার মৌজাধীন কোনো এলাকার ভুমি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তিনি কোনো পক্ষকে রিপোর্ট দেননি। বিভিন্ন সময়ে প্রভাবশালীরা রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে তাকে চাপ দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সম্মত না হওয়ায় তিনি অনেকের বিরাগভাজন হন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন