parbattanews

নাইক্ষ্যংছড়ির ৯টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে আসছে ইয়াবা : প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ধরাছোয়ার বাইরে

pic-19,05.14

নাইক্ষ্যংছড়ি প্রতিনিধি:
বান্দরবান পার্বত্য জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ৯টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে মায়ানমার থেকে আসছে ইয়াবা । বর্তমানে ওই পয়েন্ট গুলিতে ১২টি চোরাচালানী সিন্ডিকেট সক্রিয় । জানা যায়,সীমান্তরক্ষী ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে আড়াল করে ইয়াবা পাচারকারীরা নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত পয়েন্ট গুলোকে নতুন পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে । বর্তমানে  নাইক্ষ্যংছড়ির  ৯টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বানের স্রোতের মত আসছে ইয়াবা, অস্ত্র ও হরেক রকম বিদেশী মাদক । ফলে বাংলাদেশ- মিয়ানমার- থাইল্যান্ড- লাউস ভিত্তিক আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত মাদক ও অস্ত্র পাচারের অন্যতম রুট ফের চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ।

অনেক দিন ঝিমিয়ে থাকার পর এই রুট দিয়ে ব্যাপক হারে অস্ত্র,ইয়াবা ও মাদক পাচার শুরু হয়েছে । অন্যদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি, টেকনাফ,উখিয়ার মধ্য বয়সী ও টিনেজ ছেলেরা কাচাঁ টাকার লোভে এসব মাদক পাচারের কাজে ব্যবহ্নত হচ্ছে বলে জানা গেছে ।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মায়ানমার সীমান্ত ৯টি সীমান্ত পয়েন্টে বর্তমানে ১২টি চোরাচালানী চক্র সক্রিয়ভাবে ইয়াবাসহ মাদক পাচারে জড়িত রয়েছে । সিন্ডিকেটগুলো হচ্ছে, দেলোয়ার -কামাল সিন্ডিকেট , সাইফুল-লাইতুচিং সিন্ডিকেট , উজ্জ্বল -আলী হোসেন সিন্ডিকেট, বিষ্ণ কুমার দাশ – জয়নাল সিন্ডিকেট, মৌলভী সালেহ- ফয়েজ উল্লাহ সিন্ডিকেট, ইউনুছ-নুর হোসেন মেম্বার সিন্ডিকেট ,ক্যারালা অং- সেলিম সিন্ডিকেট, মেকানিক নুরুল আলম-সালেহ আহমদ সিন্ডিকেট, ফরিদ উল্লাহ-মৌলভী শাহজাহান সিন্ডিকেট , সুমন-মো. নুর সিন্ডিকেট, শামসুল আলম- ইকবাল সিন্ডিকেট, রফিক-লিটন সিন্ডিকেট। প্রত্যেক সিন্ডিকেটের সদস্য সংখ্যা ১০-১২ জন ।

জানা যায়, এসব পাচারকারীরা আশারতলীর (৪৭ নং পিলার) পর্দান ঝিরি থেকে এই ইয়াবা সংগ্রহ করে । পরে বাইক যোগে উপজেলা সদরের মসজিদ ঘোনা মজুদপূর্বক সুযোাগ বুঝে সিন্ডিকেটের অপর সদস্যদের নিয়ে কক্সবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পাচার করে দেয় । উল্লেখিত ব্যক্তিরা প্রতিরাতে বাইকের সিট কভারের ভিতর ,পাজারো, মাইক্রো, জিপ বাস যোগে ইয়াবা পাচার করে আসছে ।

পয়েন্টগুলো হচ্ছে, চাকঢালার ৪৩ নং সীমান্ত পিলার, দ : চাকঢালার কাসিম এর বাড়ী এলাকা, আশারতলীর ৪৪ নং, চেরারকূলের ৪৫ নং , কম্বনিয়ার ৪৬ নং, ৪৭ নং পর্দান ঝিরি , ৪৮ নং ফুলতলী , ৪৯ নং ভাল্লুখ খাইয়া , দৌছড়ির পাইন ছড়ি ৫২ নং, ৫১ নং কোলাচি , ঘুমধুমের বাইশ ফাড়ি,তুমরু । জানা যায়, সোনাইছড়ির লাইতুছিং মার্মা ও ওই এলাকার ফখরুল আলমের পুত্র সাইফুল ইসলাম চাকঢালার ৪৩ নং পিলার দিয়ে ফরিদের মাধ্যমে সিএনজি যোগে প্রথমে জারুলিয়াছড়ি পরে সোনাইছড়ির মারিগ্যা পাড়া দিয়ে থোয়াইঙ্গা কাটাঁ দিয়ে কক্সবাজার পাচার করে দেয় ।

সোনাইছড়ির বাসিন্দা ও বান্দরবান জেলা আওয়ামীলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এ্যানিং মার্মা বলেন, সোনাইছড়ির মারিগ্যা পাড়া দিয়ে থোয়াইগ্যা কাটাঁ ইয়াবা পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে । গুটিকয়েক ব্যক্তি এই ব্যবসা করে সুন্দর এই উপজাতীয় এলাকাটির পরিবেশ নষ্ট করছে ।  প্রধান সড়কে তল্লশি জোরদার করা হলে ,ইয়াবা ব্যবসীরা দৌছড়ির পাইন ছড়ি,কোলাচির সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ইয়াবা সংগ্রহ করে কৌশলে কক্সবাজার, চট্রগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের প্রভৃতি জায়গায় পাচার করে দেয় ।

সম্প্রতি ওই এলাকা থেকে ইয়াবা পাচার কালে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদরের ফজল কবিরের পুত্র ইকবালকে চট্রগ্রাম ডিবি পুলিশ আটক করে । ইয়াবা পাচারে মায়ানমার সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শতাধিক অল্প বয়সী যুবক, ছাত্র, বিবাহিত-অবিবাহিত নারী, সরকার দলীয় শতাধিক নেতা-কর্মী, টেকনাফ-উখিয়ার ৫জন সাংবাদিক, কিছু সংখ্যক আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত বলে সরকারী ৪/৫টি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ।

গত ৬ মে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার ইয়াবা পাচার ও ইয়াবা পাচারে সহযোগিতাকারীদের একটি প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদন নিয়ে খোদ পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা দ্বিমত পোষণ করেন । ওই প্রতিবেদনে প্রকৃত ইয়াবা ব্যবসায়ী ও পাচারে সহযোগিতাকারীগণ ধরাছোয়ার বাইরে থেকে গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায় । এই প্রতিবেদন নিয়ে পুলিশ বাহিনীতেও চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে ।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার দেবদাশ ভট্রাচার্য বলেন, কক্সবাজার ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের ইয়াবা পাচারে সহযোগিতাকারীদের তালিকা থেকে রেহায় দিতে এই বিভান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে । প্রতিবেদনে নাইক্ষ্যংছড়ির ওসিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে । মূলত: নাইক্ষ্যংছড়ির ওসি রফিকুল ইসলাম গত ২০১২ সালের বৌদ্ধ মন্দির হামলার পরবর্তী ওই উপজেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ওই মামলা গুলির আসামীদের ধরতে চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে তাকে নাইক্ষ্যংছড়ি থানায় পাঠানো হয় । পুলিশ বাহিনীতে ওসি রফিকুল ইসলামের দীর্ঘ সুনাম রয়েছে ।

এছাড়া ২০১০ সালে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ’র দায়িত্বপালনকালে উখিয়া এলাকায় ৩টি অস্ত্রসহ ৯জন দুর্ধষ ডাকাতকে হাতে নাতে আটক করার পুরস্কার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পুলিশের সর্বোচ্চ  পিপিএম পদক প্রদান করেন । পুলিশ বাহিনীতে দক্ষ ,সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে । অপরাধী ও মাদক পাচারকারীকে তিনি কখনও প্রশ্রয় দিতেন না । প্রতিবেদনে বান্দরবান জেলার প্রধান ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে নাইক্ষ্যংছড়ির সোলাইমান সওদাগরের পুত্র কামাল উদ্দিন ও বহিরাগত মোশারফ হোসেনের ছত্রছায়ায় আশারতলি, লেমুছড়ি ও ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা চালান আসে এবং বিভিন্ন স্থানে মাইক্রোবাস ও মোটর সাইকেলযোগে সরবরাহ করা হয়।

বান্দরবান জেলা শহরে পাচারকারী দলের সদস্য হিসেবে আবু তাহের, রুস্তম, নাইক্ষ্যংছড়ির ব্যবসায়ী পাড়ার কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ফরিদ উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক নজিব উল্লাহ,মসজিদ ঘোনার পরিমল দাশের পুত্র উজ্বজল দাশসহ ৩০ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে । ওই প্রতিবেদনে নাম এসেছে কক্সবাজারের ৫ জন সাংবাদিকের।

বান্দরবান সদর সার্কেলের এএসপি শিবলি কায়সার বলেছেন, আইন প্রয়োগে শক্ত অবস্থান নেওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে মাদক পাচারকারী ও তাঁদের সহযোগিরা ষড়যন্ত্র করছেন। তাকে অন্যত্র বদলি করানোর জন্য একটি মহল সুকৌশলে ঐ প্রতিবেদনে নাম উঠেয়েছেন বলে তিনি দাবী করেন । মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হুমায়ুন কবীর খন্দকার বলেছেন, তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত পদস্থ কর্তাদের ক্ষোভ ও সরকারী দলের নেতাদের বিরাজভাজন হওয়ায় এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকাভূক্ত করা হয়েছে ।

অন্যদিকে আলীকদম থানার ওসি মো.হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের হ-য-ব-র-ল প্রতিবেদন কখনই দেখিনি । সঠিক তদন্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়নি । প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তিনি উল্লেখ করেন । প্রতিবেদনে তাঁকে লামা থানার ওসি বলা হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১  বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্ণেল সফিকুর রহমান বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায়  মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্তে  রোহিঙ্গা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । এদের মাধ্যমে স্থানীয় রোহিঙ্গা নেতারা ইয়াবা পাচার ও পাচারে সহযোগিতা করে আসছে । ইয়াবা পাচারকারীকে আটকের পর তাদের ছাড়িয়ে নিতে কিছু নেতা তদবির করে । বিজিবি থেকে ছাড়তে না পেরে পুলিশের কাছে গিয়েও তদবির করতে যায় বলে জানা যায় । ইয়াবা পাচার ও চোরাকারবারী যে কেউ হোক না কেন,  সে যত বড় নেতা বা ক্ষমতাধর হোক না কেন, কোন ভাবে ছাড় দেয়া হবে না ।

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ইয়াবা  ও মাদক পাচারকারীগণ প্রতিনিয়ত পুলিশ-বিজিবি থেকে শক্ত বাধা পায় । এই বাধাঁ অতিক্রম করতে না পেরে বর্তমান থানার অফিসার ইনচার্জসহ কয়েকজন এসআই কে যে কোন ভাবে অনত্র বদলীর জন্য তদবির ও ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে । প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত । ইয়াবা পাচারকারী বা চালান আটকের পর থানায় কিছু স্থানীয় নেতা তদবির চালায় । তাদের সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী । এরা ইয়াবা সহজ উপায়ে ও নির্বিঘ্নে পাচার করতে দায়িত্ব প্রাপ্ত বিজিবি ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং সদস্যদের বদলীর জন্য নানা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে । তালিকায় পাচারে সহযোগিতাকারী হিসাবে আমার নাম আসার পরে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা হাসছে। আমি ইয়াবা ব্যবসায়ীদের শত্রু। আর নাম এসেছে ইয়াবা পাচারে সহযোগিতাকারী হিসাবে । এটা দু:খজনক’। এছাড়া তিনি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা ও সাংবাদিকদের পুণরায় তদন্ত করার জন্য দাবী জানান ।

 গত (১২ এপ্রিল ২০১৩ ইং) কিশোরগঞ্জ সদর এলাকা থেকে কিশোরগঞ্জ থানা পুলিশ নাইক্ষ্যংছড়ির ব্যবসায়ী পাড়ার মৃত মোস্তাফিজুর রহমানের পুত্র জিয়া উদ্দিনকে ৪০,৩৫০ টি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ আটক করে । গত (২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩ ইং ) চট্রগ্রাম ডিবি পুলিশ আগ্রাবাদ এলাক থেকে কচ্ছপিয়ার হাজীর পাড়ার জামসেদ নামের আরেক যুবক ইয়াবা পাচার কালে পুলিশের হাতে আটক হন । গত (৭ মে) নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের হাবিলদার মোঃ শওকত আলীর নেতৃত্বে চেরারমাঠ এলাকা থেকে মায়ানমার আকিয়াব জেলার ওয়ালিডং এলাকার মো. সৈয়দ হোসনের পুত্র মোঃ আব্দুল আজিজ(৩২) নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে । এসময় পাচারকারী থেকে ১৮৮২ টি ইয়াবা উদ্ধার করে। গত (৭ এপ্রিল) নাইক্ষ্যংছড়ির ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের নায়েক সুবেদার মোঃ শাহ আলম এর নেত্বত্বে আশারতলী বিওপি থেকে ৩০,০৩৫ টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে। গত (১৭ এপ্রিল ) নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সুবেদার আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে চাকঢালা মডেল স্কুলের সামনে থেকে ১৩,৯৫৪ পিচ ইয়াবা উদ্ধার করে ।

এ সময় কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার হাজি নুরুল আমিনের পুত্র মো. ইসমাইল হোসেন (৩৬),নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালার কালু কাটাঁর আলী আহমদের পুত্র মো. আনোয়ার হোসেন (১৮) নামের দুই ইয়াবা ব্যবসায়ীকে ইয়াবাসহ হাতে নাতে আটক করে । গত (১৬ মে) চট্রগ্রাম ডিবি পুলিশ কোতয়ালীর মোড় থেকে ৩৬,৫৫০টি ইয়াবা ট্যাবলেটসহ নাইক্ষ্যংছড়ির সিনামহল এলাকার ফজল কবিরের পুত্র মো. ইকবাল (৩৬)কে আটক করে । জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল ওই ইয়াবার চালান নাইক্ষ্যংছড়ির দৌছড়ী থেকে নিয়ে যাচ্ছিল বলে জানান ।

Exit mobile version