নাইক্ষ্যংছড়ি-মিয়ানমার সীমান্ত সিল করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: আতঙ্ক কাটেনি জনমনে

fec-image

মিয়ানমারের ভূমি থেকে ছোড়া গোলা বাংলাদেশে এসে পড়ার পর যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে অনুরূপ গোলা পড়লো । এসব ঘটনায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে আতঙ্ক বিরাজ করছে সেই থেকে অদ্যাবধি । আজ ১ মাস ৩ দিন ঘটনার প্রবাহ। এ কারণে সীমান্তে নিরাপত্তা-টহল জোরদার করাসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। বর্তমানে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা কেটেছে সীমান্ত জুড়ে। কারণ বিজিবি কঠোর অবস্থানে। রোববার সারাদিন শান্ত এ সীমান্ত এলাকা জুড়ে।

এদিকে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে বাংলাদেশে গুলি ও মর্টার শেল পড়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ঢাকার মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে রবিবার তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের ৪০ ও ৪১ নম্বরের পিলারের মাঝামাঝি স্থানে মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার টহল দেয়। এ সময় যুদ্ধবিমান থেকে ৮-১০টি গোলা আর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়।

দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি গোলা ৪০ নম্বর সীমান্ত পিলার বরাবর প্রায় ১২০ মিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। তবে এতে কোনো ধরনের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে দেশটির সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। পাশাপাশি মিয়ানমারের কোনো নাগরিক যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সংশ্লিষ্ট বর্ডার সিল করা হয়েছে।

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) জানায়, গোলা পড়ার ঘটনার পর সীমান্তে নিরাপত্তা-টহল জোরদার করাসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন বিজিবি সদস্যরা।

কোনো দেশের অভ্যন্তরে অন্য দেশের গোলা এসে পড়া আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের উচিত হবে, সামরিক সক্ষমতা বজায় রেখে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কূটনৈতিক চ্যানেলে সমাধান করতে হবে। এরপরও যদি পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে প্রতি-উত্তর দিতে হবে বলে মনে করছেন একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ভাষ্য, সীমান্তের আট কিলোমিটারের মধ্যে সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু তারা (মিয়ানমার) তা তো মানছেই না, উল্টো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বারবার ঢুকে পড়ছে। তাই কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি উত্থাপন করা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো।

এদিকে সিলেটে লাক্কাতুরা চা-বাগানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, মিয়ানমার আবারও রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটনানোর পাঁয়তারা করছে। মিয়ানমার গোলাবর্ষণের মাধ্যমে যত উসকানিই দিক না কেন সীমান্ত দিয়ে আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হবে না।

সীমান্তে বিজিবি শক্ত অবস্থানে আছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের বর্ডার সিল করেছি। মিয়ানমারের লোক আমাদের দিকে যাতে না আসতে পারে সে জন্য বিজিবিকে সতর্ক করেছি।’

মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেন, ‘আমরা অবজার্ভ করছি। মিয়ানমারের ওখানে কিছু ভায়োলেন্স হচ্ছে। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছে যে, কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আরাকান আর্মি নামক এক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংস্থা সেখানে অবস্থান করছে, যারা ওই এলাকা দখল করেছে। তাদের সাথে প্রতিনিয়ত মিয়ানমার আর্মির সংঘর্ষ হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তে এসে গোলা পড়া অনুচিত, এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আমাদের এখন দেখতে হবে গোলা পড়াটা ইচ্ছাকৃত নাকি তাদের সংঘর্ষের ফলাফল।’

মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, মিয়ানমার ইচ্ছাকৃত বাংলাদেশকে টার্গেট করে গোলাটা ছুড়ছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সামরিক সক্ষমতা বজায় রেখে ভবিষতে যেন গোলা এসে না পড়ে, সে বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে এটি সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের উচিত সীমান্তে আরো নজরদারি বাড়ানো। সামরিক উত্তেজনা বাড়ানো যত সহজ, নিষ্পন্ন করা ততটাই কঠিন।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপির আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০ ও ৪১ নম্বরের মাঝামাঝি স্থানে ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দুটি যুদ্ধবিমান এবং দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার টহল দেয়। এ সময় যুদ্ধবিমান থেকে ৮-১০টি গোলা আর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। দুই ঘণ্টার ব্যবধানে দুটি গোলা ৪০ নম্বর সীমান্ত পিলার বরাবর আনুমানিক ১২০ মিটার বাংলাদেশের ভেতের এসে পড়ে। তবে কোনো ধরনের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি হচ্ছে। দিনে ২৫ থেকে ৪০টি মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে এপারে। তবে সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদার করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, ‘নিরাপত্তা টহল জোরদারের পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বিজিবির সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন।’

এর আগে গত রবিবার (২৮ আগস্ট) ও গত পরশু শনিবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া ক’টি মর্টার শেল বান্দরবান সীমান্তের ঘুমধুম সীমান্ত এলাকার জনবসতি পাহাড়ি এলাকায় এসে পড়ে। ঘটনার পর ২ দফা তলব করা হয় ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে। কড়া প্রতিবাদ জানান ঢাকা। এর আগেও বাংলাদেশের আকাশসীমায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান মহড়া দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ঢাকা। গত রোববার সর্বশেষ ২ দফা কড়া প্রতিবাদ জানান ঢাকা।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের মংডুর ৩৮ নং সীমান্ত পোস্ট সংলগ্ন এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও রাখাইনের বিচ্ছিন্নবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: নাইক্ষ্যংছড়ি, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন