parbattanews

নিজ দেশেই শরণার্থী হবে রোহিঙ্গারা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার নাম করে আরেক ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে মিয়ানমার।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে যদি তাদের ফেরত নিতেই হয়- তাহলেও দেশে গিয়ে তারা ফেলে আসা বাড়িঘর, জমি, সম্পদ বা বসবাসের জায়গা কিছুই ফিরে পাবে না।

কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়া হবে- তা নিশ্চিত না হলেও ফেরত যাওয়া সব রোহিঙ্গাকে একপ্রকার শরণার্থী বানিয়ে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছে মিয়ানমার।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পনা বিষয়ে এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে বর্তমানে যে ফসল (ধান) রয়েছে- তা কেটে নেবে সরকার। ওই ফসল সরকার বিক্রি করে স্থানীয়দের (রোহিঙ্গা ছাড়া) উন্নয়নে কাজে লাগাবে।

আর পরিত্যক্ত চাষাবাদের জমি, বসতভিটা, পুকুর বা অনুরূপ সব সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হবে। ফেরত যাওয়ার পরও কোনো রোহিঙ্গা এসব সম্পত্তির অধিকার পাবে না।

ফেরত গিয়ে রোহিঙ্গারা পূর্বের জায়গায় বসবাসও করতে পারবে না। পুড়ে বা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের জায়গায় নতুন করে ঘর নির্মাণ করতে পারবে না। রোহিঙ্গাদের তাদের বসবাসের জায়গায় ঢুকতেই দেয়া হবে না।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত মিয়ানমারের ছয় কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে রয়টার্স। তবে কর্মকর্তাদের আলোচনায় সু চি সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা প্রকাশ করেছে রয়টার্স।

এ বিষয়ে রাখাইন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী কিয়াই লউইন বলেন, ‘জমি ও ফসলের বিষয়টি তাদের নাগরিকত্বের ওপর নির্ভর করছে। যাদের নাগরিকত্ব নেই তাদের কোনো ভূমির মালিকানা নেই।’

আন্তর্জাতিক চাপে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার চিন্তা করলেও রাখাইনে সরকার কর্তৃক নির্মিত স্থায়ী ক্যাম্পে তাদের বসবাস করতে হবে।  ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা যেভাবে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছে নিজ দেশেও ঠিক তেমনই এক পরিবেশে তাদের বসবাস করতে হবে।

রাখাইনে ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গারা তাদের বাড়িতে ফিরতে পারবে না। তাদের রাখাইন রাজ্য কর্তৃক নির্মিত স্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হবে।

বর্তমানে রাখাইনে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার। ২০১২ সালের সহিংসতার পর তাদের স্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক দাতারা এ রোহিঙ্গাদের খাবার ও দেখাশোনা করছে। কূটনীতিক ও ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, এসব ক্যাম্পে সরকার আর কোনো সহযোগিতা দেবে না। তবে জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের পদক্ষেপের সমালোচনা করে আসছে।

বর্তমানে যেসব রোহিঙ্গা ফেরত যেতে ইচ্ছুক তাদের প্রথমে দুটি কেন্দ্রে নেয়া হবে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ১৬টি দফার একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নথির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। কর্তৃপক্ষের নথির সঙ্গে মিলিয়ে তাদের স্থায়ী ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হবে।

ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে তারা পরবর্তীতে নতুন করে কোনো স্থানে বসবাস বা বাড়ি নির্মাণ করতে পারবে না। অন্য দেশে শরণার্থীদের মতোই তাদের ওই ক্যাম্পে বসবাস করতে হবে। সরকারি পরিকল্পনায় এসব তথ্য জানা গেছে।

জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টানিস্লাভ সালিং জানান, নতুন অস্থায়ী ক্যাম্প বা ক্যাম্পের মতো বসতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে। স্থায়ী ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা ও নতুন করে ফিরে আসা রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিনের জন্য সেখানে আটকা পড়তে পারেন।

রাজ্য সরকারের তথ্য মতে, রাখাইন থেকে প্রায় ৬ লাখ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। এ রোহিঙ্গাদের ৭১ হাজার ৫০০ একর ভূমিতে ফসল রয়েছে।

ফলে এখন তা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে শিগগিরই ধানকাটা শুরু হবে। জানুয়ারি মাস থেকে এসব জমিতে পুনরায় চাষাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

তবে সব জমি রোহিঙ্গাদের- এ তথ্য অস্বীকার করেছেন রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ফেলে যাওয়া জমির মধ্যে ৪৫ হাজার একর জমি রোহিঙ্গাদের।

মিয়ানমারের চাষাবাদের খরচ ও ফসল উৎপাদনের হিসাবে ১ একর জমিতে উৎপাদিত ধানের দাম প্রায় ২৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ধান বিক্রি করে সরকার কয়েকশ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে।

রাজ্য সচিব টিন মাউং সয়ি টেলিফোনে জানান, এসব ধান সরকারি গুদামে রাখা হবে। সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের তা বিতরণ বা বিক্রি করা হবে। তিনি বলেন, ‘এসব জমি পরিত্যক্ত। কেউ চাষ করার মতো নেই। ফলে সরকার চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন জানান, এ ফসল থেকে সরকারের মুনাফা করা ঠিক হবে না। তাছাড়া সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ফলে পালিয়ে যাওয়ার কারণে জমিতে ধান চাষ করা মানুষকে মালিকানাহীন বলতে পারেন না।

এইচআরডব্লিউ’র মতে, ২৫ আগস্টের পর থেকে প্রায় ২৮৮টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়ে যাওয়া এসব গ্রামের বেশিরভাগেই রোহিঙ্গাদের বাস। রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধরা গ্রামে আগুন লাগিয়েছে। সরকারের দাবি, রোহিঙ্গা জঙ্গি ও গ্রামের লোকেরা নিজেরাই আগুন লাগিয়েছে প্রচারণা পাওয়ার জন্য।

উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার পর রাখাইনে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। অভিযানের ফলে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা। এ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রেখেছে।

 

সূত্র: যুগান্তর

Exit mobile version